কুড়িগ্রামে চরবাসীর নিজেদের টাকায় নির্মিত হলো রাস্তা 

প্রকাশকালঃ ১৯ মে ২০২৪ ১২:৫৭ অপরাহ্ণ ৬৮৬ বার পঠিত
কুড়িগ্রামে চরবাসীর নিজেদের টাকায় নির্মিত হলো রাস্তা 

আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-

 

 

সরকারি রাস্তাটি সরকারি টাকায়ই পুনর্নির্মাণ হওয়ার কথা ছিল। সেই আশায় কেটে গেছে ৪০ বছরের বেশি সময়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অবশেষে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর বল্লভেরখাস ইউনিয়নের চরকৃষ্ণপুর গ্রামে স্বেচ্ছাশ্রমে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তাটি পুনর্নির্মাণ করছেন স্থানীয় চরবাসী। এতে খরচ হচ্ছে ৩০ লাখ টাকা। এত টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। বহু চেষ্টা করেও কোনো সরকারি সহায়তায় না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী। 

 

কয়েক যুগ ধরে রাস্তাটির সংস্কার না হওয়ায় স্থানীয় প্রায় ৭ হাজার মানুষ প্রতিনিয়ত কষ্ট করে চলাচল করেন। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয় এ চরের অন্তঃসত্ত্বা নারী ও বয়স্কদের। 

 

চরের বাসিন্দারা জানান, ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চরকৃষ্ণপুর থেকে ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কুমেদপুর বাজার হয়ে এই রাস্তাটি ব্যবহার করেই উপজেলা শহরে যেতে হয়। ব্যবহারের অযোগ্য রাস্তাটির কারণে বর্ষা মৌসুমে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় স্থানীয়দের। রাস্তাটি মাটি ভরাট করে পুনর্নির্মাণ করার জন্য একাধিকবার স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে গিয়েও কোনো সমাধান মেলেনি। এখন স্থানীয়রা একত্র হয়ে চাঁদা দিয়ে এবং স্বেচ্ছাশ্রমে রাস্তাটি পুনর্নির্মাণ করছেন।

 

সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, রাস্তাটি খানাখন্দে ভরা। দীর্ঘ ৪০-৪৫ বছর ধরে এভাবেই রাস্তাটি পড়ে রয়েছে। ফলে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের প্রসব যন্ত্রণা উঠলে সহজে শহরে নেওয়ার সুযোগ নেই। অন্যদিকে, কৃষকদের উৎপাদিত ফসল হাটে বিক্রি জন্য নিতেও অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে এলাকার লোকজন বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে ঘুরেও রাস্তাটি সংস্কার করাতে পারেননি। স্বেচ্ছাশ্রমে ইতোমধ্যে রাস্তাটির প্রায় এক কিলোমিটারের নির্মাণকাজও শেষ হয়েছে। এ রাস্তার পাশেই আবার সরকারিভাবে তৈরি হচ্ছে সরকারি আশ্রয় প্রকল্পের ‘মুজিব কেল্লা’। সরকারি রাস্তাটি সরকার তৈরি না করে দেওয়ায় ক্ষোভ আর হতাশা রয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। 

 

সরেজমিন আরও দেখা যায়, উপজেলা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা পেরিয়ে পুনরায় ১০ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা পারি দিতে হয়। এর পর নৌকাযোগে দুধকুমার নদ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হয় দুর্গম ইউনিয়নটিতে। এলাকাটি ভারত সীমান্তের কাছে। স্থানীয়রা বলছেন, অসময়ের বন্যা আর বৃষ্টির পানিতে বছরের বড় একটি সময় এখানকার জনপদগুলো হয়ে পড়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কৃষ্ণপুর চরের বাসিন্দাদের উপজেলা শহরসহ আশপাশের বাজারে হেঁটে যাতায়াত করতে হয়। অচল রাস্তার কারণে শুকনো মৌসুমেও পড়তে হয় চরম দুর্ভোগে। বন্যা আর বৃষ্টিতে হাঁটার রাস্তাটুকু তলিয়ে যায়। ফলে উঁচু সড়কের অভাবে জীবন-জীবিকার গতি থমকে যায় এই এলাকার মানুষের।

 

নিজেদের শ্রম আর অর্থে রাস্তাটির কাজ শুরু করতে গঠন করা হয়েছে সড়ক নির্মাণ কমিটি। কমিটির সদস্যরা জানান, রাস্তাটি তৈরি করতে ব্যয় হবে ৩০ লাখ টাকা। কমিটির সদস্যদের বিভিন্ন স্তরে কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। সদ্যসের কেউ টাকা তুলছেন, আবার কেউ খরচের হিসাব রাখছেন। কেউ কাজের গুণগত মান তদারকি করছেন। নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ, যুবক সবাই হাতে হাত রেখে কাজ করছেন। এই চরের প্রবীণ বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ আলী বলেন, ‘আজ দেশ স্বাধীন হবার ৫৩ বছর হলেও হামরা স্বাধীন হইলাম না। এই রাস্তাটার জন্য ৩০-৪০টা বছর ধরে কত জাগাত গেছি, চেয়ারম্যান, মেম্বার কেউ হামার কথা শোনে নাই।’

 

সড়ক নির্মাণ কমিটির কোষাধ্যক্ষ খালেক মিয়া বলেন, গ্রামের ধনী, গরিব সবার কাছে টাকা নেওয়া হয়েছে। যে ভিক্ষা করে, তার কাছ থেকেও ২০০ টাকা নেওয়া হয়েছে। যে একদম গরিব, তার কাছ থেকেও ১ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে। কেউ আবার ৪ হাজার, ১০ হাজার, ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন। তবে এই টাকাও খুবই কম। 

স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা নুরনবী ইসলাম বলেন, এই গ্রামে যাতায়াতে কোনো রাস্তা নেই। বহু বছর স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং ওপর মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করেও একটি সড়ক নির্মাণের ব্যবস্থা হয়নি এখানে। তাই আমরা গ্রামবাসী একত্র হয়ে নিজেদের সড়ক নিজেরাই তৈরি করছি।’

 

বল্লভেরখাস ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কৃষ্ণপুর চরের লোকজন কয়েকবার যোগাযোগ করেছে। এত বড় সড়কটি তৈরিতে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষে বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব নয়। তাই চরের বাসিন্দাদের জোটবদ্ধ হয়ে কাজটি শুরু করার পরামর্শ দিয়েছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছি।

 

কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, চর কৃষ্ণপুরবাসী সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিয়ে একটি সড়ক নির্মাণ করছেন, এটি প্রশংসনীয় কাজ। আমরা তাদের কাজে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। সরেজমিন পরিদর্শন করে সহযোগিতা প্রদান করার ব্যবস্থা করব।