ক্ষমতায় থাকতে নানা ঘটনায় শক্তিধর একাধিক বন্ধু দেশের সঙ্গে বিএনপির যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল গত ১৫ বছরেও তা আর মেরামত হয়নি। বরং গত দুই বছরে বিএনপির সঙ্গে আরো অন্তত দুটি দেশের সম্পর্ক শীতল হয়েছে। দেশ দুটি হলো জার্মানি ও জাপান।
বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে কাজ করেন এমন নেতারা বলেন, প্রতিষ্ঠাকালে চীন, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা অনেক দেশের সঙ্গে বিএনপির আস্থার সম্পর্ক ছিল। ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর কয়েকটি দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সেই অবস্থা থেকে আর বের হয়ে আসতে পারেনি দলটি।
বিএনপিতবে সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির সঙ্গে বহির্বিশ্বের সম্পর্কের বিষয়টি দলের ভেতরে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো সরকারের নানা বিষয়ে এবং আসন্ন নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলছে।
এর যতটুকু সুফল বিএনপি নিতে পারত, তা পারছে না বলে দলের শীর্ষ নেতাদের পর্যালোচনায় উঠে এসেছে। এ অবস্থায় দলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির দক্ষতা নিয়েও ভেতরে ভেতরে কথা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিদেশের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক তৈরি এবং পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে নিতে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। গত সপ্তাহে বিএনপির স্থায়ী কমিটির নিয়মিত বৈঠকেও কূটনৈতিক তৎপরতা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছে।
বৈঠকে বিএনপির বিষয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হওয়া এবং আওয়ামী লীগকে ভারতের একচ্ছত্র সমর্থনের বিষয়টি আলোচনায় আনেন কয়েকজন সদস্য। স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ভারত চায় না বলে জামায়াতে ইসলামীকে দূরে সরাতে বিএনপি ২০ দলীয় জোট বিলুপ্ত করেছে। ভবিষ্যতে তারা বিএনপির নেতৃত্ব বদল করতেও বলতে পারে; কিন্তু তাতেও কি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হবে? যদি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হয় তাহলে বিএনপি ভারত তোষামোদের নীতি পরিবর্তন করবে না কেন? স্থায়ী কমিটির অন্তত চারজন সদস্য এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন।
ওই বৈঠকের পর বিএনপির কয়েকটি কর্মসূচিতে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ভারতের সমালোচনা করে বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ এই তালিকায় নেতার সংখ্যা বাড়ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মানে এই নয় যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিএনপির বিশেষ কোনো সুসম্পর্ক আছে।
বৈদেশিক সম্পর্ক নিয়ে যতই আলোচনা বাড়ছে ততই চাপে পড়ছে বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটি। এই কমিটির সদস্যসংখ্যা ২১ ছিল। তবে বর্তমানে সক্রিয় দেখা যায় তিনজনকে। এঁরা হলেন কমিটির চেয়ারম্যান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ এবং দলের মানবাধিকার সম্পাদক আসাদুজ্জামান। দলের পক্ষে সব সময় মুখর রুমিন ফারহানা এই কমিটির সদস্য হলেও কমিটিতে তিনি সক্রিয় নন। একই অবস্থা রিয়াজ রহমান, এনামুল হক চৌধুরী, আসাদুজ্জামান রিপন, জেবা খান, নওশাদ জমির, ফাহিমা মুন্নি, অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, তাবিথ আউয়াল, মীর হেলাল উদ্দিন, ইশরাক হোসেন প্রমুখ।
এর কারণ জানতে চাইলে নেতারা জানান, গঠনের পর থেকে গত সাড়ে চার বছরে কমিটির একটি মাত্র আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। অবহিতকরণ সভা হয়েছে কয়েকটি। ফলে সদস্যরা কমিটির কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্য রুমিন ফারহানা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দল হয়তো মনে করে, আমার যোগ্যতা নেই। তাই আমাকে ডাকে না। আমিও যাই না। অন্যরা কেন যায় না, তা আমার জানা নেই।’
বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির একাধিক নেতা কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ঢাকায় বিদেশি দূতাবাসগুলোর বেশির ভাগের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে ঘাটতি আছে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের। কূটনীতিকদের সৌজন্যে ডাকা দলের অনুষ্ঠানে বিদেশিদের উপস্থিতি দিন দিন কমে যাওয়া এর প্রমাণ বলে মনে করছেন অনেকে।
দলীয় সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিএনপি আয়োজিত দুটি অনুষ্ঠানে হাতে গোনা কয়েকজন কূটনীতিক এসেছিলেন। গত ২৯ জুলাই বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিতে বাধা ও হামলার ঘটনায় ২ আগস্ট কূটনীতিকদের ব্রিফ করে দলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি। অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির ছয়জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। ওই দিন বিএনপি থেকে জানানো হয়েছিল, ২৫টি দেশের কূটনীতিক উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, ঢাকায় নিযুক্ত মাত্র ৯টি দেশের প্রতিনিধি ওই ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে সবাই কূটনীতিকও ছিলেন না। এ নিয়ে দলের ভেতরে নানা আলোচনা হচ্ছে।
গত ১৪ আগস্ট বিএনপির একটি সেমিনারে আমন্ত্রিত কূটনীতিকদের মধ্যে মাত্র চারটি দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। দলীয় সূত্রগুলো জানায়, এই দুটি অনুষ্ঠানের বিষয় নিয়ে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন। ২ আগস্টের কূটনীতিকদের ব্রিফিংকে বিএনপি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিল। এ জন্য দলের স্থায়ী কমিটির ছয়জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সেই বিবেচনায় কূটনীতিকদের উপস্থিতি ছিল হতাশাজনক।
কূটনীতিক পর্যায়ে যোগাযোগ রাখেন এমন একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, বৈদেশিক যোগাযোগের বিষয়টিতে নিরন্তর দৃষ্টি রাখতে হয়। পেশাদার কূটনীতিক ছিলেন এমন কেউ এখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটিতে নেই। ফলে বহির্বিশ্বের চলমান বিষয়গুলো সেভাবে খেয়াল রাখা হয় না। কূটনীতিক পর্যায়ে যাঁদের যোগাযোগ ভালো তাঁরাও কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন।
জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিদেশিদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বেশ ভালো। বিএনপি তিনবার ক্ষমতায় ছিল। আবার ক্ষমতায় আসবে। বিদেশিরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, আমরাও রাখছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘কারো সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ, এমনটি আমি দেখছি না।’
জার্মানি অসন্তুষ্ট, জাপানও নাখোশ। গত বছরের ১৭ মার্চ জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টারের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। ওই বৈঠকের পর স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে অসন্তোষ জানান রাষ্ট্রদূত।
ওই বছরের ২০ এপ্রিল জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে জার্মান রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমি যে উদ্ধৃতি পড়েছি তা বাস্তবের সঙ্গে মিলছে না। সেখানে বলা হয়েছে, আমি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও গণতন্ত্র নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। এমন শব্দচয়ন সত্য নয়। এতে আমি কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়েছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আমার যে বৈঠক হয়েছে, সেখানে বিএনপি নেতারা কেন নির্বাচনে অংশ নেননি বা নিতে চান না সেই বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। এর বেশি কিছু নয়।’
বিএনপির সংশ্লিষ্ট নেতারা জানান, এর পর থেকে ঢাকার জার্মান দূতাবাস বিএনপির কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহ দেখায় না।
গত ৪ জুন জাপান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিএনপির বৈঠকের পর আমীর খসরু মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপির সময় জাপান থেকে প্রচুর বিনিয়োগ এসেছিল। প্রচুর অবকাঠামোগত বিনিয়োগ বাংলাদেশে হয়েছে। তারা দেখতে চায় সরকার বদল হলেও যাতে এটা অব্যাহত থাকে।
বিএনপি সূত্র জানায়, সরকার বদল হলেও সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে চায় জাপান—আমীর খসরুর এ বক্তব্যে জাপান বেশ নাখোশ হয়। বৈঠকে সরকার বদলের বিষয়ে জাপান কোনো মন্তব্য করেনি বলে বিভিন্ন মাধ্যমে বিএনপিকে জানিয়েছে তারা।
মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের বৈঠকে চেয়েও পায়নি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, সম্প্রতি ঢাকা সফরে আসা মার্কিন দুই কংগ্রেসম্যানের সঙ্গে শেষ মুহূর্তে বৈঠক করতে চেয়েছিল বিএনপি। কিন্তু তাতে সাড়া মেলেনি। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এক টেবিলে বৈঠকের আমন্ত্রণ পেয়ে বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি তাতে অংশ নেন।
এর কয়েক দিন আগে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) শীর্ষ কর্মকর্তার ঢাকা সফরের সময় বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটি বৈঠক করার আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু তেমন কোনো বৈঠক হয়নি। তবে বিএনপির দুজন নেতার সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ওই কর্মকর্তার কথা হয়।
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, আইআরআই সম্প্রতি বাংলাদেশের বিষয়ে যে জরিপ প্রতিবেদন দিয়েছে (৭০ শতাংশ মানুষ মনে করে, শেখ হাসিনা ভালো কাজ করেছেন), তা আগে থেকেই বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটি জানত। প্রতিবেদনটি পেয়েও কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা এ নিয়ে দলের ভেতরে কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা করেননি। ফলে দল হিসেবে বিএনপি আইআরআইয়ের প্রতিবেদনের বিষয়ে যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিল, তা ছিল কিছুটা দুর্বল।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, বিদেশিরা বিশেষ কোনো দলের সঙ্গে সম্পর্ক দেখায় না। এটা তাদের কৌশল। তিনি বলেন, ‘বিদেশিদের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক আছে। বহির্বিশ্ব বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলছে। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করতে নানা সুপারিশ করছে। এই ক্ষেত্রে বিএনপির সঙ্গে কূটনীতিকদের আকাঙ্ক্ষার মিল আছে।’