প্রকাশকালঃ
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৪:০৬ অপরাহ্ণ ২৫৩ বার পঠিত
আজকাল অনেকেই থাইরয়েডের সমস্যায় ভুগছেন। প্রয়োজনে নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছেন। তবে মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা রয়েছে যে এটা শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের হয়। সেটি সঠিক নয়। পুরুষদের তুলনায় যেমন নারীরা বেশি থাইরয়েডে আক্রান্ত হন, তেমনই কম বয়সি বা শিশুদের মধ্যেও এই রোগ দেখা দিতে পারে। নবজাতকের মধ্যে থাইরয়েডের সমস্যা নতুন ঘটনা নয়।
আমাদের গলায় থাকে থাইরয়েড গ্রন্থি। এর মধ্যেই তৈরি হয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু হরমোন। থাইরয়েড গ্রন্থি হয় অতিরিক্ত পরিমাণ থাইরয়েড উৎপন্ন করে, নয়তো পরিমাণের তুলনায় কম হরমোন উৎপন্ন করে। সেই সঙ্গে শরীরের অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ার ওপরেও প্রভাব ফেলে। ফলে অনিদ্রা, ওজন হ্রাস, ওজন বেড়ে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, মন খারাপ এসব লেগেই থাকে। কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু আলাদা।
মূলত, জেনেটিক কারণে শিশুদের মধ্যে থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা বংশানুক্রমিক। অনেক ক্ষেত্রে আবার বাচ্চাদের শরীরে আয়োডিনের অভাব থাকলেও থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দিতে পারে। আয়োডিন থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনে সাহায্য করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে কোনও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে থাইরয়েড হরমোন নিঃসরণ কমে যেতে পারে বা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এমন ঘটনা নবজাতকের মধ্যে দেখা না গেলেও, ছোট বাচ্চাদের মধ্যে ঘটে থাকে।
ছোটদের থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা, রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা নিয়ে বুঝিয়ে দিলেন ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের শিশুরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. দিব্যেন্দু রায়চৌধুরী। তিনি জানাচ্ছেন, থাইরয়েডের সমস্যা দুই রকমের হয়। হাইপোথাইরয়েডিজম বা থাইরয়েড হরমোন কম ক্ষরণজনিত সমস্যা ও হাইপারথাইরয়েডিজম অর্থাৎ এই হরমোন বেশি ক্ষরণের সমস্যা। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি হাইপোথাইরয়েডিজমই বেশি দেখা যায়। প্রাইমারি হাইপোথাইরয়েডিজমের কারণগুলো হল:
কোনও ‘অটোইমিউন’ (যেখানে অনাক্রম্যতা শক্তি শরীরকেই আক্রমণ করে) কারণে হতে পারে।
বাচ্চার থাইরয়েড গ্রন্থি ভালো করে তৈরি না হলে স্বাভাবিক ভাবেই থাইরয়েডের ক্ষরণ কম হয়।
থাইরয়েডের সংক্রমণ বা কোনও অসুখের কারণে শল্যচিকিৎসা করে বাচ্চার থাইরয়েড গ্রন্থির কিছুটা বাদ দিলেও হাইপোথাইরয়েডিজম হয়।
গর্ভাবস্থায় মা কিছু বিশেষ ধরনের ওষুধ খেলেও বাচ্চার হাইপোথাইরয়েডিজম হয়।
বাচ্চা ‘লিথিয়াম’, ‘অ্যামিয়োডারোন’ জাতীয় ওষুধ খেলেও তার এই সমস্যা হতে পারে।
এছাড়া কোনও কারণে রেডিয়েশন দেওয়া বা জোরে আঘাত লাগলেও সেকেন্ডারি হাইপোথাইরয়েডিজম হতে পারে।
দেহের ‘হরমোন রিসেপ্টর সিস্টেম’ ঠিক ভাবে কাজ না করলেও বাচ্চার শরীর থাইরয়েড হরমোনের কার্যকারিতার সুফল গ্রহণ করতে পারে না।
হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণ কী কী
বাচ্চার সার্বিক বিকাশে কমতি থাকে। একে বলে ক্রেটিনিজম। বাচ্চার জিহ্বা বড় হতে পারে, মুখটা ফোলা ফোলা লাগে। পেশিতে শৈথিল্য থাকে। পেটটা ফোলা লাগে। থাইরয়েডের কারণেও খুব ছোট বাচ্চার আম্বিলিক্যাল হার্নিয়া (নাড়ি ফুলে থাকা)হতে দেখা যায়। হাড়ের গঠনে সমস্যা হতে পারে। ত্বক খসখসে হয়, কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা যায় ও অল্পতেই বাচ্চার শীত করবে। কনজেনিটাল হাইপোথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে (যেখানে জন্ম থেকেই থাইরয়েড গ্রন্থি ঠিক মতো কাজ না করার ফলে থাইরয়েড ক্ষরণ কম থাকে) মস্তিষ্কের বিকাশে প্রভাব পড়তে পারে। মানসিক গঠন ঠিক মতো হয় না, আই কিউ লেভেল কমের দিকে থাকতে পারে। এর ফলে শারীরিক বৃদ্ধি সময় মতো হয় না। ব্রহ্মতালু সময়মতো বন্ধ হয় না (অর্থাৎ জন্মের পর যেমন ছিল, স্ক্যাল্পের একটি গোলাকার অংশ সে রকমই দপদপ করতে থাকে)।
প্রতিকারের উপায়
ডা. রায়চৌধুরীর মতে, খুব সহজেই কনজেনিটাল হাইপোথারয়েডিজম রুখে দেওয়া সম্ভব। শিশুর জন্মের পর থাইরয়েড স্ক্রিনিং করা হয়। তাতে সেরাম টি-ফোর আর টিএসএইচ-এর মাত্রা দেখে নেওয়া হয়। সেরাম টি-ফোর কম বা টিএসএইচ বেশি থাকলেই বোঝা যায় যে, বাচ্চার হাইপোথাইরয়েডিজম হচ্ছে। তখনই হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি শুরু করে দেওয়া হয়। এর ফলে বাচ্চা একেবারে সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে যায়। তার কোনও মানসিক সমস্যা থাকে না। অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে শারীরিক বা মানসিক কোনও পার্থক্য থাকে না। কিন্তু এই সময়ে যদি রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা শুরু করা না হয়, তবে বাচ্চার মস্তিষ্ক স্থায়ী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় আর ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না।
জন্মের কয়েক মাস বা কয়েক বছর পরেও যদি হঠাৎ থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা হয় তবে লক্ষণ দেখে হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপিতে ওষুধের ডোজ নির্ধারণ করা হয়। ছোট বাচ্চার ক্ষেত্রে প্রতি কেজি ওজনের জন্য ডোজ বেশি, বড়দের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি ওজনে ডোজ কম।