করোনাকাল শুরুর আগে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার বাজারে এক হালি ডিমের দাম ছিল ২৮ থেকে ৩০ টাকা। রাজধানীর বাসিন্দাদের সেই ডিম এখন কিনতে হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়।
বাজারে ডিমের এই চড়া দাম কোনো সাময়িক সমস্যা নয়, বরং মাসের পর মাস ধরে ডিম নাগালের বাইরে থাকছে। ফলে সহজলভ্য এই প্রাণিজ আমিষ খেতে পারছেন না নিম্ন আয়ের মানুষ। শুধু ডিম নয়, চড়া মাছ ও মাংসের বাজারও। ফলে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষও বিপাকে রয়েছে।
ছোট ও মাঝারি খামারিরা বলছেন, ডিমের দাম নির্ধারণে তাঁদের ভূমিকা নেই। বাজারে ‘সিন্ডিকেট’ গড়ে উঠেছে। তারা যে দাম ঠিক করে দেয়, সেই দরেই বিক্রি হয়। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ১৩ আগস্ট ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে না এলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে।
একই দিন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম সাংবাদিকদের বলেন, দেশে যে ডিমের উৎপাদন, তাতে সঠিক ব্যবস্থায় বিন্যাস হলে আমদানির কোনো প্রয়োজন নেই।
মন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর বাজারে অভিযান চালানো শুরু হয়। কিন্তু ডিমের দাম কমেছে ডজনে ১০ থেকে ১৫ টাকা। এখন বড় বাজারে এক ডজন ফার্মের মুরগির বাদামি ডিমের দাম ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকা। পাড়া–মহল্লার মুদিদোকান থেকে এক হালিডিম কিনতে হচ্ছে ৫৫ টাকায়। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানে ডিমের দাম অনেকটাই কম।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সংবাদদাতা জানান, সেখানে গতকাল শনিবার প্রতি ৩০টি ডিম বিক্রি হয়েছে ১৬০ রুপিতে। তাতে প্রতিটি ডিমের দাম পড়েছে ৫ রুপি ৩৩ পয়সা যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭ টাকা ৫ পয়সা।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ভলান্টারি কনজ্যুমারস ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস সোসাইটির (ভোক্তা) নির্বাহী পরিচালক মো. খলিলুর রহমান ভারতের চেন্নাই থেকে গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় ফিরেছেন। তিনি জানান, গত বুধবার তিনি চেন্নাইয়ে ৬টি ডিম কিনেছেন ৪২ রুপি দিয়ে। বাংলাদেশি মুদ্রায় হালি পড়েছে ৩৭ টাকা।
পাকিস্তানের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ১৭ আগস্ট দেশটিতে প্রতি ডজন ডিমের দাম ছিল প্রায় ২৯৪ রুপি। তাতে প্রতিটি ডিমের দাম পড়ে ২৪ দশমিক ৪৭ রুপি, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৯ টাকার মতো।
মূল্যস্ফীতিতে জর্জরিত শ্রীলঙ্কায় ডিমের দাম বাংলাদেশের চেয়ে এখন বেশি। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, ১৮ আগস্ট সেখানে একটি ডিমের দাম ছিল ৪১ রুপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৪ টাকার কিছু কম। অবশ্য কয়েক দিন আগেই বাংলাদেশের মানুষকে একটি ডিম ১৫ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে।
বছরজুড়ে ডিমের দাম সাধারণত ১০০ টাকার আশপাশে থাকত। তবে ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় ডিমের ডজন ১৫০ টাকার আশপাশে ছিল।
কেন নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না, জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয় প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের সঙ্গে। তিনি অস্ট্রেলিয়ায় একটি অনুষ্ঠানের থাকার কথা উল্লেখ করে পরে কথা বলবেন বলে জানান। কিন্তু আর সাড়া পাওয়া যায়নি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এমদাদুল হক তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ততার কথা বলে ফোন রেখে দেন।
ডিমের মূল্যবৃদ্ধির জন্য তিনটি বিষয়কে দায়ী করছেন খামারি ও ব্যবসায়ীরা: ১. পোলট্রি খাবারের মূল্যবৃদ্ধি। ২. উৎপাদন কমে যাওয়া। ৩. বাজারে কারসাজি।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মূলত ডিমের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। আগস্টে ডজন ১৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এর পর থেকে কখনো দাম ১০ টাকা বেড়েছে, কখনো কমেছে, কিন্তু বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মুরগির খাদ্যের উপকরণের দাম বেড়েছিল। তবে দাম কমেছেও। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত পাঁচ–ছয় মাসে মুরগির দাম নতুন করে বাড়েনি; বরং কিছু কিছু কমেছে। ফলে খাদ্যের দামের কারণে নতুন করে ডিমের মূল্যবৃদ্ধির যুক্তি নেই।
বাজারে কারসাজি কীভাবে হয় তার উদাহরণ দিলেন নরসিংদীর মরজাল মাঝারি খামারের মালিক ফারুক আহমেদ। তিনি জানান, ১২ হাজার মুরগির খামারটি থেকে তিনি দিনে ১০ হাজারের মতো ডিম পান। সর্বশেষ গত শুক্রবার তিনি খামার থেকে ডিম বিক্রি করেছেন। ওই দিন মরজাল এলাকার খামারিরা প্রতিটি ডিমের দাম পেয়েছেন ১০ টাকা ৭০ পয়সা।
ফারুক আহমেদ গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে বলেন, ঢাকার ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন খুদে বার্তা (এসএমএস) দিয়ে ডিমের দাম জানিয়ে দেন। ওই দামে ডিম বিক্রি করতে চাইলে স্থানীয় মিডিয়াম্যান (মধ্যস্থতাকারী) খামারে গাড়ি নিয়ে আসেন। দাম বাড়তি চাইলে ডিম নেন না। তিনি আরও বলেন, খামারিরা দাম কম পেলেও মধ্যস্বত্বভোগীরা বেশি মুনাফা করেন। এ কারণে ক্রেতাকে ১৪ টাকা দিয়ে ডিম কিনতে হয়।
একই ধরনের বক্তব্য দেন জয়পুরহাটের ছোট খামারি মেজবাউল মারফি। তিনি বলেন, ‘ডিম বাজারে নিয়ে গেলে আমাদের যে দাম দেওয়া হয়, সেই দামেই বিক্রি করতে হয়।’
খামারমালিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানী ঢাকার জেলা শহর বা বড় বাজারকেন্দ্রিক মধ্যস্বত্বভোগীরা দাম নির্ধারণে বেশি ভূমিকা রাখছেন। যেসব খামারের উৎপাদন বেশি, বিশেষ করে বড় করপোরেটরাও দাম নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। এ কারণেই বাজারে অভিযান শুরু হলে দাম দ্রুত কমে যায়। আবার কিছুদিন পরে বেড়ে যায়।
অবশ্য কারসাজির অভিযোগ অস্বীকার করেন বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি শামসুল আরেফিন। তিনি বলেন, ডিমের বাজারে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে বড় কোম্পানিগুলো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, তা বলা যাবে না।
উৎপাদন কমেছে, বেড়েছে চাহিদা
বিপিআইসিসির তথ্যানুযায়ী, দেশে সাধারণত ডিমের উৎপাদন দিনে ৪ কোটির ওপরে থাকে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে তা আরেকটু বেশি। আবহাওয়ার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ডিমের উৎপাদন কিছুটা কমেছে। বড় খামার পর্যায়ে এখন ডিমের উৎপাদন দিনে ৬০ লাখের মতো। আর ছোট খামারি পর্যায়ে ৩ কোটি ৩৩ লাখ।
সব মিলিয়ে ডিমের উৎপাদন এখন ৪ কোটির নিচে। কিন্তু বাজারে চাহিদা বেশি। একই সঙ্গে মাছ ও মাংসের চড়া দামের কারণে সাধারণ মানুষ ডিমের প্রতি ঝুঁকছে।
কাজী ফার্মস গ্রুপের পরিচালক কাজী জাহিন হাসান বলেন, আবহাওয়ার কারণে ডিমের উৎপাদন এখন কম। আবার বাজারে ডিমের চাহিদাও বেড়েছে। তাতে দামে একটু ওঠানামা করছে। তিনি বলেন, বাজারে এমন অস্থিরতা থাকলে বড় বিনিয়োগকারীরা এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। তখন পুরো খাতই ঝুঁকিতে পড়বে। মানুষের আমিষের জোগান ব্যাহত হবে।
কোনো পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হলে সাধারণত আমদানি হয়। বাংলাদেশে ডিম আমদানি কার্যত নিষিদ্ধ। আমদানি করতে হলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আগাম অনুমোদন নিতে হয়। গত নভেম্বরে ৬টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ৫১ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানিয়েছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মতামত চেয়েছিল প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের; কিন্তু সম্মতি পাওয়া যায়নি। ডিমও আমদানি হয়নি। মানুষকে চড়া দামেই ডিম খেতে হচ্ছে।
রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বেসরকারি চাকরিজীবী হাসিবুল হাসান বলেন, মাছ-মাংসের দাম এত বেশি যে অল্প বেতন পাওয়া মানুষের পক্ষে কেনা কঠিন। ডিমে খরচ কম। তিনি বলেন, ‘সপ্তাহে কয়েক দিন ডিম, ডাল ও আলুভর্তা দিয়ে ভাত খেতাম। এখন ডিমের দাম বেশি, আলুর কেজি ৪০-৪৫ টাকা।’
ডিম খাওয়া যে কমেছে, তা উঠে এসেছে সরকারের খানা আয়–ব্যয় জরিপ ২০২২–এর প্রতিবেদনে। এতে দেখা যায়, দেশের মানুষ দিনে মাথাপিছু ১২ দশমিক ৭ গ্রাম ডিম খায়, যা ২০১৬ সালে ছিল ১৩ দশমিক ৫৮ গ্রাম।
দেশে দাম বেশি কেন
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতে পোলট্রি খাদ্যের কাঁচামালের দাম কম। এ কারণে উৎপাদন ব্যয় কম। খাদ্য উৎপাদনকারীদের সংগঠন ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, মুরগির খাবারের কাঁচামাল ভুট্টা ও সয়াবিন থেকে শুরু করে ৭০ শতাংশ উপকরণই আমদানি করতে হয়। কাঁচামালের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার না করা হলে খাদ্যের দাম কমানো কঠিন।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০২২ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে মুরগির খাদ্যের মূল উপকরণ ভুট্টা প্রতি টনের দাম ৩২২ মার্কিন ডলার ছিল। গত জুলাইয়ে তা ২৪২ ডলারে নেমেছে। আরও কিছু উপকরণের দাম কমেছে। অবশ্য মার্কিন ডলারের দাম বেড়েছে।
আবার খাদের দাম কমবেশি হওয়ার কারণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রায় দ্বিগুণ দামে ডিম বিক্রি হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলেও মনে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। খামারমালিকদের সংগঠনের দাবি, একটি ডিমের উৎপাদন খরচ সাড়ে ১০ টাকা। ছোট খামারে আরেকটু বেশি। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশে উৎপাদন ব্যয় এত বেশি কেন দাবি করা হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ডিমের উৎপাদন খরচের হিসাব তৈরি করছে।
ডিমের বাজারের সার্বিক বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্যসচিব গোলাম রহমান বলেন, সরকার ভূমিকা রাখতে চাইলে যে পারে না, বিষয়টা এমন নয়। তবে এখানে সদিচ্ছার অভাব আছে বলে মনে হয়। তিনি বলেন, পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা না গেলে ধরে–বেঁধে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।