জাতীয় সংসদে নতুন আয়কর আইন পাসের জন্য বিল আকারে উত্থাপিত হয়েছে। বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশের সঙ্গে নতুন আইনে বড় মৌলিক পরিবর্তন নেই। তবে কিছু কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।
যেমন কোম্পানির সংজ্ঞা পরিবর্তন; কোম্পানিকে প্রতি মাসে উৎসে করের রিটার্ন দাখিল; রিটার্নের প্রমাণ দাখিলে বাধ্যবাধকতায় আরও পাঁচ খাত যুক্ত, বিদেশে ঘুরতে গেলে সম্পদের তথ্য দেওয়া ইত্যাদি। আবার কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) বাতিলের সুযোগ রাখা হয়েছে। বাড়িভাড়া, যাতায়াত, চিকিৎসায় সাড়ে চার লাখ টাকা পর্যন্ত কর ছাড় দেওয়ার প্রস্তাবও করা হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ‘আয়কর বিল ২০২৩’ জাতীয় সংসদে তোলেন। পরে বিলটি পাঁচ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। আয়কর আইনে সব মিলিয়ে ২৫টি অধ্যায়, ৩৪৫টি ধারা, ৮টি তফসিল আছে। আয়কর আইনটি বাংলা ভাষায় প্রণীত হয়েছে।
গত বছরের শেষ দিকে আয়কর আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৩৭০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে আয়কর আইন পাস করানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
আইনটি সম্পর্কে এনবিআরের সাবেক সদস্য (আয়কর নীতি) সৈয়দ আমিনুল করিম বলেন, ‘মোটা দাগে আইনটি ভালো হয়েছে। বাংলা ভাষায় হওয়ায় করদাতাদের জন্য সহজবোধ্য হয়েছে। বর্তমানে আয়কর অধ্যাদেশের ৩৩ জায়গায় কর কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। নতুন আইনে এত জায়গায় এ ধরনের ক্ষমতার কথা বলা নেই। তবে কর কর্মকর্তা ও করদাতা—উভয়ের এই আইনে অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে।’
কিছু কিছু ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত করদাতাদের চাপ বাড়বে বলে মনে করেন সৈয়দ আমিনুল করিম। তিনি জানান, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, যাতায়াতে কর ছাড় আছে। এখন সাড়ে চার লাখ টাকা বা মোট আয়ের দুই-তৃতীয়াংশ যা কম সেটি প্রযোজ্য হবে। এতে ছোট চাকরিজীবীদের সুবিধা আগের চেয়ে কমবে। এ ছাড়া করদাতাদের সঙ্গে আরও আলোচনা করে আইনটি জাতীয় সংসদে নিয়ে গেলে আরও ভালো হতো বলে মনে করেন তিনি।
যেসব পরিবর্তন আছে
এবারের আয়কর আইনে কোম্পানি সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এনজিও, শিল্প ও বাণিজ্য সংগঠন, ফাউন্ডেশন, সমিতি, সমবায় সমিতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কোম্পানির সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের করহারসহ অন্যান্য নিয়মকানুন কোম্পানি হিসেবে পরিপালন করতে হবে।
বর্তমানে যেসব কোম্পানি বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে উৎসে কর কাটে, তাদের বছরে দুবার উৎসের করের বিস্তারিত জানিয়ে এনবিআরে রিটার্ন জমা দিতে হয়। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ, বিদ্যালয় ব্যতীত অন্য সব কোম্পানি; ফার্ম, ব্যক্তিসংঘ, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে প্রতি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে আগের মাসের উৎসে কর আদায়ের রিটার্ন দাখিল করতে হবে।
বর্তমানে ৩৮টি সরকারি-বেসরকারি সেবা নিতে হলে বার্ষিক আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র লাগে। নতুন আইনে এই তালিকায় আরও পাঁচটি খাত ঢোকানো হয়েছে।
এগুলো হলো: ১. নির্দিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক সিটি করপোরেশন এলাকায় বাড়িভাড়া বা লিজ গ্রহণের সময় বাড়ির মালিকের; ২. নির্দিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক সেবা বা পণ্য গ্রহণকালে ওই পণ্য বা সেবা সরবরাহকারীর; ৩. ট্রাস্ট, তহবিল, ফাউন্ডেশন, এনজিও, ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী সংস্থা, সোসাইটি ও সমবায় সমিতির ব্যাংক হিসাব খুলতে ও চালু রাখতে; ৪. স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি ও কার্টিজ পেপারে ভেন্ডর বা দলিল লেখক হিসেবে নিবন্ধন, লাইসেন্স বা তালিকাভুক্তি করতে বা বহাল রাখতে; ৫. রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে এমন গঠিত কর্তৃপক্ষ বা অন্য সিটি করপোরেশন, পৌরসভায় অনুমোদনের জন্য ভবন নকশার আবেদন দাখিলকালে।
অন্যদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা আছে, এমন করদাতার মোট আয় করমুক্ত সীমা অতিক্রম না করলেও আয়ের পরিমাণ—নির্বিশেষে ন্যূনতম করের পরিমাণ দুই হাজার টাকা হবে।
নতুন আইনে কোনো করবর্ষে কোনো করদাতা যদি চিকিৎসা বা হজসহ ধর্মীয় উদ্দেশ্যে বিদেশ গমন ছাড়া অন্য কোনো কারণে ব্যক্তিগতভাবে বিদেশে যান, তাহলে তাঁকে সম্পদের বিবরণী জমা দিতে হবে। এ ছাড়া কোনো করদাতা যদি দেশের বাইরে সম্পদ কেনেন, তাহলেও তাঁকে সম্পদের বিবরণী দিতে হবে। কোনো কোম্পানির শেয়ারধারী পরিচালক হলেও সম্পদের বিবরণী জমা দিতে হবে। সম্পদ বিবরণী দাখিলে এই তিনটি নতুন শর্ত যুক্ত কর হয়েছে।
বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশে আয়কর রিটার্ন জমার সময় বর্তমানে সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনটি শর্ত আছে। এ তিন শর্তের একটি প্রযোজ্য হলেই সম্পদের বিবরণী দেওয়া বাধ্যতামূলক। শর্তগুলো হলো: ১. অর্থবছরে মোট সম্পদের পরিমাণ ৪০ লাখ টাকা হলে; ২. একটি মোটরগাড়ির মালিক হলে; ৩. সিটি করপোরেশন এলাকায় গৃহ-সম্পত্তি বা অ্যাপার্টমেন্টের মালিক হলে। এসব সম্পদে বিনিয়োগ করলেই বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সম্পদের রিটার্ন দিতে হয়।
এ ছাড়া দেশের কারও বিদেশে সম্পদ থাকলে তা যদি কর কর্মকর্তারা প্রমাণসহ জানতে পারেন, তাহলে ওই সম্পদের বিপরীতে জরিমানা আরোপ করার বিধান রাখা হয়েছে নতুন আইনে।
নতুন আয়কর আইনে টিআইএন বাতিলের সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে কয়েকটি শর্ত রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো পরপর তিন বছর করযোগ্য আয় না থাকলে এবং শারীরিকভাবে অক্ষমতার কারণে ভবিষ্যতে কোনো করযোগ্য আয় হবে না; মৃত্যু, অবসায়ন ও অবলুপ্তি বা অনুরূপ কারণে কোনো কারণে অস্তিত্বহীন হলে, স্থায়ীভাবে বাংলাদেশ ত্যাগ করলে এবং বাংলাদেশে কোনো আয় উপার্জক কোনো কর্মকাণ্ড না থাকলে।
নতুন আইন অনুযায়ী, একজন করদাতা সারা বছরে সব ভাতার টাকার মধ্যে সাড়ে চার লাখ টাকা পর্যন্ত কিংবা বার্ষিক মোট আয়ের দুই-তৃতীয়াংশ—এর মধ্যে যেটি কম তা করমুক্ত থাকবে। এবারের বাজেটে এসব ভাতার ওপর কত টাকা পর্যন্ত কর ছাড় আছে, সেই প্রজ্ঞাপন বাতিল করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত নেওয়ার নিয়মেও কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেমন করদাতার মোট আয়ের ৩ শতাংশ বা নিয়মমাফিক মোট বিনিয়োগের ১৫ শতাংশ কিংবা ১০ লাখ টাকা—এর মধ্যে যেটি কম হবে, তাই বিনিয়োগজনিত কর রেয়াতের পরিমাণ হবে।
এ ছাড়া নতুন আইনে পুনর্গঠন-মার্জার, ডিমার্জারকে ট্যাক্স নিউট্রাল করে আইনি বিধান করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া স্টার্টআপ পরিবেশ শক্তিশালী করতে স্টার্টআপ স্যান্ডবক্সের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অবশ্য গতবারই সন্নিবেশিত করা হয়। এ ছাড়া কর কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছা ক্ষমতা কমানোর বিধান সন্নিবেশিত করা হয়েছে।