কিয়ামত বিষয়ে যেসব সতর্কতা জরুরি

প্রকাশকালঃ ১২ এপ্রিল ২০২৩ ০১:০৭ অপরাহ্ণ ২৮৯ বার পঠিত
কিয়ামত বিষয়ে যেসব সতর্কতা জরুরি

কিয়ামতের নিদর্শন সম্পর্কিত যাবতীয় আলোচনা ইলমু আখিরিজ জামানের অন্তর্ভুক্ত। ইংরেজিতে যাকে ‘ইস্কাটোলজি’ বলা হয়। ইলমু আখিরিজ জামানের সহজ অর্থ  Roadmap to End of The History  বা ইতিহাসের পরিসমাপ্তির রূপরেখা জ্ঞান। পবিত্র কোরআনের বহু আয়াত ও হাদিসের কিতাবুল ফিতান, কিতাবুল আশরাত, কিতাবুল মালহামা ইত্যাদি অধ্যায়গুলোতে প্রচুর ‘ইসলামিক ইস্কাটোলজি’ আছে।

কিয়ামতের নিদর্শন জানতে হবে কেন?


ভবিষ্যতের বিষয়াবলিতে মানুষের কৌতূহল স্বভাবজাত। ইসলাম একদিকে সব মিথ্যাবাদী, অপপ্রচারক, জ্যোতিষী, গণকদের দুয়ার বন্ধ করেছে, অপরদিকে ভবিষ্যতের বিষয়াবলিকে বিশদ বিবরণের মাধ্যমে সংশয়ের শঙ্কা চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসের সমাপ্তির রূপরেখা পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। আকস্মিক কোনো কিছুর সম্মুখীন হওয়ার চেয়ে ভবিষ্যৎ সংঘটিত বিষয়াবলির জন্য মানসিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রে যা সহায়ক। তা ছাড়া তা ইসলামের প্রতি বিশ্বাস প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি, ইসলামের বিজয়ে প্রত্যাশা, ইবাদতে বিপুল উৎসাহ, বিচার দিবসের পূর্ণ প্রস্তুতি ইত্যাদির ক্ষেত্রে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। ঈমানের ছয়টি মৌলিক বিষয়ের মধ্যে কিয়ামতের প্রতি বিশ্বাস একটি। এই জ্ঞানের সত্যতার মাধ্যমে নবীজির (সা.) মুজিজা তথা নবুওয়তের সততা ও সত্য হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে।

কিয়ামতের নিদর্শন ব্যাখ্যার মূলনীতি

কিয়ামতের নিদর্শন বিষয়ে পূর্ব ও পরবর্তী আলেমরা বহু পুস্তক ও গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেছেন। ড. আবদুর রহমান আরেফি তাঁর ‘দ্য ইন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ (নিহায়াতুল আলম) বইতে এসব ব্যাখ্যার কিছু মূলনীতি বিশ্লেষণ করেছেন। কিয়ামতের নিদর্শনসংবলিত বাণীগুলোকে বিগত এবং বর্তমানকালের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের সঙ্গে জোরপূর্বক মেলানোর অপচেষ্টা প্রত্যক্ষ করা হয়। এ বিষয়ে মূলনীতি অনুসরণ না করলে তা ব্যাপকভাবে ভুল বিশ্লেষণের শিকার হবে।


১. কিয়ামতের যেকোনো নিদর্শন কেবল কোরআন ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। দুর্লভ ও বানোয়াট অনির্ভরযোগ্য বর্ণনা গ্রহণ না করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনি অদৃশ্যের জ্ঞানী। তিনি অদৃশ্য বিষয় কারো কাছে প্রকাশ করেন না তাঁর মনোনীত রাসুল ছাড়া। তখন তিনি তাঁর সামনে ও পেছনে প্রহরী নিযুক্ত করেন।’ (সুরা মুজ্জাম্মিল, আয়াত : ২৬-২৭)

২. কিয়ামতের আলামত সম্পর্কিত নস (ভাষ্য) এবং তাওজিহ (ব্যাখ্যা)-কে সমমান মনে না করা। পবিত্র কোরআন কিংবা হাদিসের কোনো ভাষ্যে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তার ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণে সন্দেহ-সংশয় থাকতে পারে। এ জন্য ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে কেউ সন্দেহ প্রকাশ করলে পক্ষান্তরে কোরআন-হাদিসকে অস্বীকার করার দাবি তোলা সম্পূর্ণ অবান্তর। সহিহ মুসলিমে বর্ণিত নবীজি (সা.)-এর বাণী ‘অচিরেই এমন সময় আসবে, যখন ইরাকবাসীদের কাছে টাকা পয়সা ও খাদ্যদ্রব্য আমদানি বন্ধ হয়ে যাবে’ হাদিসের ভাষ্য ঠিক আছে। কিন্তু তার ব্যাখ্যা হিসেবে কারো কারো বিশ্লেষণ ১৯৯০ সালে ইরাকের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার সময়কে নির্দিষ্টকরণ সম্পূর্ণ সন্দেহমুক্ত নয়। আব্বাসীয় আমলেও অনেকে এ হাদিসের বাস্তবায়ন হয়েছিল ধারণা করেছিলেন। আবার আরো কঠিন সময়ের অভিজ্ঞতা হয়তো ইরাকের জন্য অপেক্ষা করছে।

৩. কিয়ামতের লক্ষণগুলো অতি সন্নিকটেই ঘটতে হবে এমন নয়; বরং এমন অনেক নিদর্শন বহু আগেই ঘটে থাকতে পারে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের প্রথম বাতাসে আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে। (মুস্তাদরিকে হাকিম)

কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘স্বয়ং নবীজি (সা.) কিয়ামতের প্রথম নিদর্শন। নবীজির ইন্তেকাল, মিথ্যা নবুওয়ত দাবিদারদের আত্মপ্রকাশ ইত্যাদি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। দোকানপাট কাছাকাছি হওয়া, বই-পুস্তক লেখালেখি অত্যধিক বেড়ে যাওয়া, হানাহানি-খুনাখুনি সীমাতিরিক্ত হওয়া কিয়ামতের ক্রমে প্রকাশ পাওয়া নিদর্শন। অদ্ভুত প্রাণীর আত্মপ্রকাশ, দাজ্জালের আবির্ভাব, ইমাম মাহদির আগমন ইত্যাদি এখনো সংঘটিত হয়নি।

৪. কিয়ামতের নিদর্শনগুলোর কোনো একটি কেবল কোনো এক ঘটনার সঙ্গে বা ব্যাখ্যার সঙ্গে সুনির্দিষ্ট না করা। নবীজি (সা.) বলেন, ‘কিয়ামত সংগঠিত হবে না যতক্ষণ না হেজাজের ভূমি থেকে বিশাল অগ্নিকুণ্ড প্রকাশ হবে, যার আলোতে বসরার উটের পিঠ আলোকিত হয়ে উঠবে। (সহিহ মুসলিম)

ইমাম নববী ও ইবনু হাজার আস্কালানি (রহ.)-সহ বহু আলেমই মনে করেন ৬৫৪ হিজরিতে মদিনার পূর্বদিকে সংঘঠিত বিশাল অগ্নিকুণ্ডই হচ্ছে সেই ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবায়ন।

৫. কিয়ামতের নিদর্শনের ভুল ব্যাখ্যার আশঙ্কা থেকে সৃষ্ট পরিস্থিতি থেকে সতর্ক থাকা। অনেকেই ইমাম মাহদি সম্পর্কে লিখিত গ্রন্থাবলি পাঠ করে মাহদির পক্ষে বৃহত্তম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে ঘোড়া-তরবারি নিয়ে এমনভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে যে দাজ্জালের আবির্ভাব হয়ে যাওয়ার ভয়ে বিয়ে-শাদী কিংবা ঘর নির্মাণের পরিকল্পনা মাথা থেকে বাদ দিতে হচ্ছে! কেউ কেউ কারো বিষয়ে মাহদি হিসেবে এত নিশ্চিত হয়েছেন যে পরবর্তী সময়ে প্রত্যাশিত মাহদি থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন কাজের জন্য লজ্জিত হতে হচ্ছে!


৬. জনগণের বিবেক-বুদ্ধি ও ধারণক্ষমতা অনুযায়ী হাদিস ও ব্যাখ্যা বর্ণনা করা। কোনো কোনো আলেম কিয়ামতের নিদর্শনাবলি নিয়ে সর্বসাধারণের সামনে বিশাল আলোচনা শুরু করে দেন, যা অনেক সময় মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ধারণ করতে পারে না। অথচ জানলেই যে বলতে হবে কিংবা সঠিক হলেই প্রচারাভিযানে নামতে হবে এমনটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ যা ভালো মনে করে (ধারণ ক্ষমতানুসারে) তাই তার কাছে বর্ণনা করো। অন্যথায় তারা আল্লাহ তাঁর রাসুলকে মিথ্যা করুক তোমরা কি তা চাও?’ (সহিহ বুখারি)

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, বিবেক-বিরুদ্ধ কোনো কথা প্রকাশ করলেই জাতির মাঝে ফেতনা ছড়িয়ে পড়বে। অতএব তোমরা তা কোরো না।

প্রয়োজন সতর্কতা

সিরাত ও ইসলামী তারিখ সামনে রেখে ‘ইসলামী ইস্কাটলজি’ কিংবা ইলমু আখিরিজ জামানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হবে। উপরন্তু কিয়ামতের নিদর্শন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নবীজি (সা.) ও সাহাবিদের বুঝের অনুসরণ অপরিহার্য। কেবলমাত্র নৈরাশ্যমূলক প্ররোচনা জনগণকে সঠিক পথ নির্দেশনা দেবে না। বর্তমানে বিষয়টিকে উত্তেজনাকর পরিবেশ সৃষ্টি এবং বাণিজ্যিক সফলতা লাভের উপকরণ বানিয়ে নেওয়া হয়েছে, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও ভীতিকর। এ ছাড়া তা কোরআন ও হাদিসের বিকৃতিও বটে।