“আমার সন্তানরা এখনো বুঝতে পারে না তাদের বাবা আর ফিরবে না। ওরা বলে, ‘বাবা ঘুমাচ্ছে মা, তুমি কেঁদো না।’ কিন্তু আমি কীভাবে বোঝাই, ওদের বাবা আর কোনোদিন জাগবে না! আবুল কালামই ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা। এখন আমি আর আমার সন্তানরা দিশেহারা।”—কান্নাভেজা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর ফার্মগেটে মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড পড়ে প্রাণ হারানো আবুল কালামের স্ত্রী আইরিন আক্তার পিয়া।
আজ সোমবার সকালে শরীয়তপুরের নড়িয়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ কবরস্থানে দাফনের পর বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন আইরিন। তাঁর বুকফাটা আহাজারিতে কেঁদে ওঠে আশপাশের মানুষজন। সকাল ১০টা ২০ মিনিটে সম্পন্ন হয় তরুণ ব্যবসায়ী আবুল কালামের দাফন। এর আগে সকাল নয়টার দিকে উপজেলার ঈশ্বরকাঠি গ্রামের নিজ বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় জানাজা। জানাজায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্বজন, আত্মীয়স্বজন ও অসংখ্য গ্রামবাসী অংশ নেন। প্রিয়জনের বিদায়ে শোকের আবহ নেমে আসে পুরো গ্রামে—কেউ অঝোরে কাঁদছিলেন, কেউ আবার নির্বাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন কফিনের দিকে।
এর আগে রোববার রাত ১০টার দিকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের নতুন আইলপাড়া এলাকার বায়তুল ফালাহ জামে মসজিদে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অংশ নেন তাঁর সহকর্মী, প্রতিবেশী ও স্থানীয় শত শত মানুষ।
নিহত আবুল কালাম আজাদ ঢাকায় একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করতেন। জীবিকার তাগিদে বিমানের টিকিট বিক্রি করতেন তিনি। স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের আইলপাড়ায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। পরিবারটির একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য ছিলেন তিনি।
রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর ফার্মগেট মেট্রো স্টেশন সংলগ্ন বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের সামনে মেট্রোরেলের একটি ভারী বিয়ারিং প্যাড ছিটকে পড়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান পথচারী আবুল কালাম। আকস্মিক এ দুর্ঘটনায় হতভম্ব হয়ে পড়ে আশপাশের লোকজন।
আবুল কালামের স্ত্রী আইরিন আক্তার পিয়া বলেন, “রোববার দুপুরে ফোনে জানায়, বাচ্চাদের বাবা এক্সিডেন্ট করেছে, হাসপাতালে ভর্তি। তখন থেকেই আমার বুকের ভেতর সব শূন্য হয়ে যায়। আমার বাচ্চারা এখনো বোঝে না তাদের বাবা আর ফিরবে না। তারা বলে—‘ডেডি কোথায়? ডেডি আমার জন্য চকলেট আনো, রুটি আনো।’ আমি কীভাবে ওদের বোঝাই, ডেডি আর আসবে না!”
তিনি আরও বলেন, “আমরা হয়তো সাধারণ মানুষ, কিন্তু কারও ক্ষতি করিনি। আমার কলিজার টুকরো বাচ্চাদের বাবাকে ফেরত দেন—যেন ওরা সারাজীবন বাবাকে দেখতে পারে। ওদের বয়সই বা কত! এখন ওরা কার কাছে যাবে, কার আশ্রয়ে থাকবে? আমাদের অভিভাবক ছিলেন তিনিই। তাঁর চলে যাওয়ায় আমরা তো এখন দিশেহারা, একরকম এতিম হয়ে গেলাম।”
সরকারের কাছে কিছু চাওয়ার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি অসহায়ের কণ্ঠে বলেন, “সরকারের কাছে কী চাইবো? কত দুর্ঘটনা ঘটে—তাদের কি কিছু যায় আসে? তারা তো আমার স্বামীকে আর ফেরত দিতে পারবে না। আমার কলিজার টুকরো মানুষটা চিরতরে চলে গেছে। এখন আমার কিছুই চাওয়ার নেই।”
নড়িয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) লাকী দাস বলেন, “আবুল কালামের মর্মান্তিক মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁর জানাজা ও দাফনে উপস্থিত ছিলাম। পরিবারটি যেন কোনোভাবেই অসহায় না হয়—সেজন্য প্রশাসন সার্বক্ষণিক তাদের পাশে থাকবে।”