রমজানে রোজাদারের চারটি গুরুত্বপূর্ণ করণীয়

প্রকাশকালঃ ১৯ মার্চ ২০২৪ ১০:২১ পূর্বাহ্ণ ২৮৯ বার পঠিত
রমজানে রোজাদারের চারটি গুরুত্বপূর্ণ করণীয়

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম একটি স্তম্ভ হলো রমজান মাসের রোজা। রোজা শব্দটি ফারসি, আরবিতে একে সাওম বলা হয়। সাওমের আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা‌, রমজান শব্দটি ‘রামজ’ ধাতু থেকে নির্গত। এর অর্থ হলো দহন করা, জ্বালিয়ে দেওয়া বা পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেওয়া।


স্বর্ণকে যেভাবে আগুনে পোড়ালে খাঁটি হয়, এ রমজানও তেমনি রোজাদারদের পশুবৃত্তিকে জ্বালিয়ে দেয় বলে এই মাসকে রমজান বলা হয়। মানুষকে সাধারণত সুপ্রবৃত্তি ও কুপ্রবৃত্তি নামক দুটি বিপরীতমুখী চরিত্রের জ্ঞান দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতঃপর তিনি তাকে তার অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন।’ (সুরা : আশ শামস, আয়াত : ৮)

 

সুপ্রবৃত্তিগুলো মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয় বা তাকওয়ার গুণ তৈরি করে। অন্যদিকে কুপ্রবৃত্তি মানুষের মধ্যে লোভ, মোহ, মিথ্যা, হিংসা, প্রতারণা ও অশ্লীল কাজে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে সমাজজীবনে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। নফস ও কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে মনুষ্যত্বের উন্নতি সাধনের অন্যতম মাধ্যম হলো রোজা। শুধু পানাহার ও জৈবিক চাহিদা ত্যাগ করার নাম রোজা নয়। বরং রোজা হলো সর্বান্তকরণে আল্লাহর সামনে নিজেকে সোপর্দ করার নাম। 


রোজার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হলো তাকওয়া অর্জন করা। আর তাকওয়ার এক অর্থ হলো আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্তু থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা। প্রকৃত রোজাদারের হাত, পা, চোখ, মুখ ও অন্তঃকরণকে সব অন্যায় থেকে সংযত রাখতে হয়। এ সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা সম্পাদিত হয় এমন গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হয়। এ লক্ষ্যে রোজাদারের করণীয় হলো :


জবানের হেফাজত করা


মানুষের জবানের হেফাজত হলো অনর্থক কথাবার্তা, অশ্লীল ভাষা, মিথ্যা, গিবত-পরনিন্দা, ঝগড়া ফ্যাসাদ ও অশ্লীল বাক্য বিনিময় থেকে বিরত থাকা। এগুলো মানুষের দুনিয়াবি জীবনে যেমন ক্ষতিকর, তেমনি আখিরাতেও আল্লাহর ক্রোধের কারণ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন কারো পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি স্বীয় মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণাই করো।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১২)


ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.) নিজের জিহ্বা টেনে ধরে কাঁদতেন আর বলতেন এই জিহ্বাই আমাকে সব বিপদ-আপদের সম্মুখীন করেছে। তাই আত্মশুদ্ধির এই মাসে জিহ্বার পাপ থেকে দূরে থাকার জন্য প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি রোজা অবস্থায় মিথ্যাচারিতা ও মন্দ কাজ করা পরিত্যাগ করেনি তার পানাহার পরিত্যাগের কোনোই গুরুত্ব আল্লাহর কাছে নেই। আল্লাহ তাআলা তার পানাহার ত্যাগ করার কোনোই পরোয়া করেন না। (বুখারি, হাদিস : ১৯০৩)


যদি অন্য কেউ তাকে গালিগালাজ করে কিংবা মারধর করে তাহলে সে যেন (তদ্রূপ আচরণ বা গালির প্রতিউত্তর গালি না দিয়ে) শুধু এতটুকু জানিয়ে দেয় যে আমি রোজাদার। (বুখারি, হাদিস : ১৯০৪)


দৃষ্টিশক্তির হেফাজত করা


দৃষ্টিকে সর্বপ্রকার গুনাহ থেকে হেফাজত করা প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য। যেমন, বেগানা নারীদের প্রতি দৃষ্টিপাত করা, অশ্লীল নাটক-সিনেমা ও মুভি দেখা থেকে বিরত থাকাই হলো দৃষ্টিশক্তির হেফাজত। জারির ইবনে আবদুল্লাহ বাজালি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ইচ্ছা ছাড়াই হঠাৎ কোনো বেগানা নারীর ওপর দৃষ্টি পতিত হলে সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নাও।’ (মুসলিম, হাদিস : ২১৫৯)


আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা বনি আদমের জন্য জিনার একটি অংশ নির্ধারিত রেখেছেন। সে তাতে অবশ্যই জড়িত হবে। চোখের জিনা হলো দেখা, জিহ্বার জিনা হলো কথা বলা, কুপ্রবৃত্তি কামনা ও খাহেশ সৃষ্টি করা এবং যৌনাঙ্গ তা সত্য অথবা মিথ্যা প্রমাণ করে। (বুখারি, হাদিস : ৬২৪৩)


শ্রবণশক্তির হেফাজত


গান-বাজনা, গিবত শ্রবণ মানুষের অন্তরে নিফাক বা কপটতা তৈরি করে। অনুরূপভাবে অশ্লীল কথাবার্তাও মারাত্মক বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে অবশ্যই এমন কতগুলো দলের সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশমি কাপড়, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল জ্ঞান করবে। তেমনি এমন অনেক দল হবে, যারা পাহাড়ের ধারে বসবাস করবে, বিকেল বেলায় যখন তারা পশুপাল নিয়ে ফিরবে তখন তাদের কাছে কোনো অভাব নিয়ে ফকির এলে তারা বলবে, আগামী দিন সকালে তুমি আমাদের কাছে এসো। এদিকে রাতের অন্ধকারেই আল্লাহ তাদের ধ্বংস করে দেবেন। পর্বতটি ধসিয়ে দেবেন, আর বাকি লোকদেরকে তিনি কিয়ামতের দিন পর্যন্ত বানর ও শূকর বানিয়ে রাখবেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৫৯০)


অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হেফাজত করা


জবান, চোখ ও কানের পাশাপাশি মানুষের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ হলো হাত ও পা। হাতের কাজ সম্পাদন করা আর পায়ের কাজ চলাফেরা করা। হাত-পা কে গুনাহ ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখা, কাউকে কষ্ট না দেওয়া, হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করা রমজানের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই কান, চোখ, হৃদয় এর প্রতিটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩৬)


প্রত্যেক মুমিন তার সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে অন্য মুমিনকে কষ্ট দেওয়া থেকে সুরক্ষিত রাখবে। এটা রমজানের দাবি, ঈমানের দাবিও বটে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘একবার আল্লাহর রাসুল (সা.) মিম্বরে চড়ে উচ্চশব্দে বলেন, হে জনগণ (মুনাফেকের দল!) যারা মুখে মুসলিম হয়েছ এবং যাদের অন্তরে এখনো ঈমান প্রবেশ করেনি (তারা শোনো), তোমরা মুসলিমদের কষ্ট দিয়ো না, তাদের লাঞ্ছিত কোরো না এবং তাদের ছিদ্রান্বেষণ কোরো না। যেহেতু যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের দোষ অনুসন্ধান করে আল্লাহ তার দোষ অনুসন্ধান করেন। আর আল্লাহ যার দোষ অনুসন্ধান করেন তিনি তাকে অপদস্থ করেন; যদিও সে নিজ গৃহাভ্যন্তরে থাকে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২০৩৮)