ঢাকার কেরানীগঞ্জে ডেঙ্গু আতঙ্ক বিরাজ করছে , শনাক্ত হয়েছে ৩৪ জন

প্রকাশকালঃ ১৩ জুলাই ২০২৩ ১১:২৪ পূর্বাহ্ণ ৩২৫ বার পঠিত
ঢাকার কেরানীগঞ্জে ডেঙ্গু আতঙ্ক বিরাজ করছে , শনাক্ত হয়েছে ৩৪ জন

ঢাকার কেরানীগঞ্জে ডেঙ্গু আতঙ্ক বিরাজ করছে গত কয়েক দিন থেকে। চলতি বর্ষা মৌসুমে এ পর্যন্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছেন আরো দুজন ডেঙ্গু রোগী। ফলে জনমনে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য পৃথক ডেঙ্গু কর্নারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুবিষয়ক নিয়মিত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশের ৫৬ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে। এর মধ্যে গত এক সপ্তাহে রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগীর প্রকোপ পৌনে দুই গুণ বাড়লেও রাজধানীর বাইরের হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে তিনগুণ। 


কেরানীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, শুভাঢ্যা, আগানগর, জিনজিরা, শাক্তা, বাস্তা, রোহিতপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার বসতবাড়ির আশপাশের খানাখন্দে পানি জমে রয়েছে।

এতে মশা ও মশার লার্ভা কিলবিল করছে। মশা নিধনে উপজেলা প্রশাসনের কোনো পদক্ষেপ না থাকায় এডিস মশা জন্মের হার দিন দিন বেড়েই চলছে। ডেঙ্গু আতঙ্কের মধ্যে স্কুল-কলেজের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বাধ্য হয়ে দিনে ও রাতে মশারি টানিয়ে পড়ালেখা করতে দেখা গেছে।

কালিন্দী ইউনিয়নের বাসিন্দা আবুল হোসন জানান, আমাদের বাসার পাশে ডেঙ্গু রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে।


এই খবর শুনে আতঙ্কে ছেলেমেয়েদের মশারি টানিয়ে পড়ালেখা করাচ্ছি। উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারের উচিত মশা নিধনের ওষুধ ছিটানোসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি বিল্লাল হোসেন বলেন, তিনি শুভাঢ্যা পশ্চিমপাড়া এলাকায় ভবন নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেন। পাঁচ দিন আগে হঠাৎ জ্বর অনুভব করলে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানতে পারেন তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত।

কাজ করার সময় প্রচুর মশা কামড়ায় তাকে। শুভাঢ্যা এলাকায় যেখানে সেখানে ময়লা আর্বজনা আর পঁচা পানি জমে থাকে। সেখানে প্রচুর মশা দেখেছেন বলে দাবি করেন তিনি।


জিনজিরা এলাকার গৃহিনী সুইটি আক্তার জানান, ঈদের ছুটিতে পরিবারের সবাইকে রিয়ে বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে যাই। কিন্তু চতুর্দিকে যেভাবে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে তার জন্য ছেলে-মেয়ে নিয়ে বাড়িতেই রয়েছি কোথাও বেড়াতে যাই নাই। উপজেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের দ্রুত এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

শুভাঢ্যা এলাকার আরেক গৃহিনী আসমা আক্তার বলেন, সাত দিন ধরে বাচ্চার জ্বর। গত ৭ তারিখে রক্ত পরীক্ষা করায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে। ওর শরীর পুড়ে যাচ্ছে, আবার ব্যথাও, কিছু খেতে চায় না। আল্লাহ যেন কোনো বাচ্চার ডেঙ্গু রোগ না দেয়। আবারও যেন মশা না কামড়ায়, তাই মশারির মধ্যেই আছি।

আগানগর ইউনিয়নের কদমতলী এলাকার নৈশপ্রহরী মো. নুর ইসলাম জানান, আমি কদমতলী এলাকায় নৈশপ্রহরীর কাজ করি। ডিউটি করার সময় কখন যে মশার কামড় খেয়েছি বুজতে পারিনি। প্রথমে জ্বর হলো পরে শরীর কাপাকাপি করলে মিটফোর্ড হাসপাতালে যাই। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানতে পারি আমার ডেঙ্গু হয়েছে। এরপর ৭ দিন ভর্তি থেকে মোটামুটি সুস্থ হয়ে বাড়িতে এসেছি।


এদিকে গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন এলাকার প্রায় শতাধিক ডেঙ্গু রোগী রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালসহ উপজেলার বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এদের মধ্যে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মিটফোর্ড  হাসপাতালের রোগী মোরশেদ আহমেদ ও ফরিদা বেগমকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। বাকিরা চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে গেছেন।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের গিয়ে দেখা যায় রোগীর চাপ বেশি। হাসপাতালের বেডে কোনো জায়গা নাই। মেঝেতেও হাসপাতালের বারান্দায় কোনো রকম একটি ফোম ফেলে চিকিৎসা নিচ্ছে ডেঙ্গু রোগীরা।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. আরাফাতুর রহমান বলেন, বর্ষায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। এখন সতর্ক থাকার কোনো বিকল্প নেই। ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার ও মশার বংশবিস্তার রোধ করা প্রয়োজন। পরিত্যক্ত পাত্র, ফুলের টব বা ডাবের খোসায় জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। এ কারণে অযথা কোনো পাত্রে পানি জমতে দেওয়া যাবে না। একই সঙ্গে বাড়ির আশপাশ সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ডেঙ্গুর লক্ষণ প্রকাশ পেলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।


এছাড়া কেরানীগঞ্জের জিনজিরা, আগানগর ও শুভাঢ্যা ইউনিয়ন গণবসতি এলাকা।  এখানেই ডেঙ্গু রোগীর প্রকোপ বেশি। এইসব এলাকার রোগীরা বেশি চলে যায় রাজধানীর  স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল ও বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকে। এই তিন ইউনিয়নের আমরা মাইকিং ও লিফলেটের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার ব্যবস্থা হাতে নিচ্ছি। শিগগিরই উক্ত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে আলোচনা করে কাজ শুরু করব।

এদিকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. কাজী রশিদ-উন-নবী বলেন, কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা জানুয়ারিতে ৪৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১০ জন, মার্চে ১৪ জন ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হন। কিন্তু এপ্রিল থেকে মে পর্যন্ত ভর্তির সংখ্যা বেড়ে ১২০ জনে দাঁড়ায়। জুনে তা আরো বেড়ে ৫৯৮ জন হয়। মে থেকে জুনে এক মাসের ব্যবধানে প্রায় পাঁচগুণ বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। ১০ জুলাই পর্যন্ত মিটফোর্ডে ৭৫৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হন। তাদের ৬৩০ জন সুস্থ হয়েছেন। বর্তমানে ১২৫ জন ভর্তি আছেন। এখন পর্যন্ত ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফলে আমাদের হাসপাতালেও রোগীর চাপ বাড়ছে। যেহেতু রোগী বেশি তাই সবাইকে শয্যা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমরা কাউকে ফিরিয়েও দিচ্ছি না। যথাসাধ্য চেষ্টা করছি সেবা দিতে।

তিনি বলেন, ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে যারা আসছে, তাদের অনেকেই দেরি করে আসছে। জ্বর বেশি দিন থাকায় তাদের প্লেটলেট কম থাকে। তখন চিকিৎসা দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। তাই জ্বর এলে ডেঙ্গুর টেস্ট করে  দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।