নতুন বছরের শুরুতে শিশুদের হাতে বিনা মূল্যে যে পাঠ্যবই দেওয়া হয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রে ছাপা হয়েছে অযত্ন–অবহেলায়। কাগজের মানে আগের চেয়ে অবনতি হয়েছে। ছাপাও হয়েছে নিম্নমানের।
যেমন সপ্তম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের একটিতে ৬৬ নম্বর পৃষ্ঠায় নৌকায় আরও কয়েকজনের সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ছবি রয়েছে। কিন্তু ছবি পরিচিতি (ক্যাপশন) পড়া ছাড়া বোঝার উপায় নেই যে সেটা বঙ্গবন্ধুর ছবি। ছবিতে থাকা অন্যদেরও কোনোভাবেই চেনা যায় না।
১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারে গণমানুষের কাতারে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা দিচ্ছেন—এমন একটি ছবি রয়েছে একই বইয়ের ৭৩ নম্বর পৃষ্ঠায়। সেটিও ঝাপসাভাবে ছাপা হয়েছে।
চারটি শ্রেণির বিভিন্ন বই সংগ্রহ করে দেখার পর শিক্ষক, অভিভাবক, মুদ্রণকারী এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার সরকারি সিদ্ধান্তেই বইয়ের উজ্জ্বলতা কমিয়ে ধরা হয়েছে। আর দুটি শ্রেণির বই শেষ সময়ে তাড়াহুড়া করে ছাপতে যাওয়া, মুদ্রণকারীদের অতি মুনাফার লোভ ও গাফিলতি এবং তদারকির অভাবে বইয়ের ছাপার মান খারাপ হয়েছে। এখনো সবাই বই পায়নি। কারণ, ছাপা শেষ হয়নি।
মুদ্রণবিভ্রাটে সাতক্ষীরার শিক্ষার্থীদের দেওয়া তৃতীয় শ্রেণির ইসলাম শিক্ষার ৩১ হাজারের বেশি বই ফেরত নেওয়া হয়েছে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ৩১ কোটির মধ্যে কিছুসংখ্যক বইয়ে ভুলভ্রান্তি বা ছাপার কাজ কিছু খারাপ হওয়া অসম্ভব নয়। তবে নিয়ম অনুযায়ী, মুদ্রণবিভ্রাট ও ভুলত্রুটি হলে তা ১৫ দিনের মধ্যে ঠিক করে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, সাতক্ষীরায় অল্প কিছু বইয়ে মুদ্রণবিভ্রাট হয়েছে, সব জায়গায় নয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।
অবশ্য বই নিয়ে এমন ‘গাফিলতি’ নতুন নয়। ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যবইয়ে ভুল ও অসংগতি নিয়ে বিতর্কের পর শিক্ষাবর্ষের মধ্যেই ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি বই (ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের অনুসন্ধানী পাঠ) আকস্মিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়। এবার বই দুটি পাঠ্য হিসেবেই রাখা হয়নি। ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সব কটি বইয়ে ভুলভ্রান্তি ছিল, যা নিয়ে পরে সংশোধনী দেয় এনসিটিবি।
সব বই যায়নি
এবার প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ শেষ হলেও মাধ্যমিকের শেষ হয়নি। ফলে বছর শুরু হলেও অনেক শিক্ষার্থী পুরো বইয়ের সেট পায়নি।
ঢাকার সেগুনবাগিচা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক এ কে এম ওবাইদুল্লাহ ২ জানুয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, সেদিন পর্যন্ত অন্যান্য শ্রেণির বই এলেও অষ্টম ও নবম শ্রেণির কিছু বই আসেনি।
এনসিটিবির সূত্রমতে, অষ্টম ও নবম শ্রেণির মোট ১০ কোটির কিছু বেশি বইয়ের মধ্যে বিপুলসংখ্যক বই ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছাপা শেষ হয়নি। এনসিটিবির কর্মকর্তাদের আশা, এই দুই শ্রেণির অবশিষ্ট বই সর্বোচ্চ ১০ জানুয়ারির মধ্যেই শিক্ষার্থীরা পেয়ে যাবে।
‘ভালো মানের বই দেওয়া উচিত’
এনসিটিবির সবচেয়ে বড় কাজ হলো শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও বই তৈরি। কিন্তু এনসিটিবির কর্মকর্তাদের অনেকেরই বেশি আগ্রহ থাকে বই মুদ্রণের কাজে। এ নিয়ে এনসিটিবির কর্মকর্তাদের মধ্যেই নানা আলোচনা আছে।
এ অবস্থায় বই মুদ্রণের কাজটি এনসিটিবির হাতে না রেখে আলাদাভাবে কোনো প্রতিষ্ঠান করে তাদের দায়িত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এনসিটিবির মূল কাজ হলো শিক্ষাক্রম উন্নয়ন, গবেষণা ইত্যাদি কাজ করা। বই ছাপার কাজটি আলাদা হওয়া উচিত।
মনজুর আহমদ বলেন, বিনা মূল্যে নতুন বই দেওয়ার উদ্দেশ্য ভালো। কিন্তু শিশুদের হাতে ভালো মানের বই দেওয়া উচিত।