সপ্তাহজুড়েই শেয়ারবাজারে লেনদেন ও মূল্যবৃদ্ধিতে শীর্ষস্থানীয় কোম্পানির অধিকাংশই বিমার

প্রকাশকালঃ ২২ জুলাই ২০২৩ ১১:২৬ পূর্বাহ্ণ ২৩৩ বার পঠিত
সপ্তাহজুড়েই শেয়ারবাজারে লেনদেন ও মূল্যবৃদ্ধিতে শীর্ষস্থানীয় কোম্পানির অধিকাংশই বিমার

দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গত সপ্তাহ ছিল যেন বিমাময়। সপ্তাহজুড়েই লেনদেন ও মূল্যবৃদ্ধিতে শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই ছিল বিমা খাতের। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই বিমা খাতের বেশির ভাগ শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। তাই এ মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কারসাজি রয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা।

দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ডিএসইতে গত সপ্তাহের শেষে মূল্যবৃদ্ধিতে শীর্ষ ১০ কোম্পানির মধ্যে ৬টিই ছিল বিমা খাতের। কোম্পানিগুলো হলো জনতা ইনস্যুরেন্স, কন্টিনেন্টাল ইনস্যুরেন্স, ক্রিস্টাল ইনস্যুরেন্স, এশিয়া প্যাসিফিক ইনস্যুরেন্স, প্যারামাউন্ট ইনস্যুরেন্স ও গ্লোবাল ইনস্যুরেন্স। এর মধ্যে জনতা ইনস্যুরেন্স ও ক্রিস্টাল ইনস্যুরেন্স সম্প্রতি তাদের শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএসের তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, দুই কোম্পানিরই মুনাফা বেড়েছে। শেয়ারবাজারে কোনো কোম্পানির ইপিএসের তথ্য মূল্য সংবেদনশীল হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। তাই ইপিএস কমলে বা বাড়লে তাতে শেয়ারের দামে প্রভাব পড়ে।

জানতে চাইলে বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউআইইউ) বাণিজ্য অনুষদের অধ্যাপক মোহাম্মদ মুসা প্রথম আলোকে বলেন, বিমা খাতের বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ছে গুজবে। বিমা কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম আয় বাড়ার কারণে মুনাফা বাড়বে এমন গুজব ছড়িয়ে একটি গোষ্ঠী শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে। এদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থাও বাজারে লেনদেন বাড়াতে তৎপর। সেই সুযোগই নিচ্ছেন কারসাজিকারীরা।

গত এক সপ্তাহে কিছু বিমা কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়লেও কোনো তদন্তের উদ্যোগ নেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ডিএসই কর্তৃপক্ষ দাম বাড়ার কারণ জানতে চেয়ে কয়েকটি কোম্পানিকে চিঠি দিয়ে দায় সেরেছে। জবাবে কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধির কারণ তাদের জানা নেই।


লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের সাপ্তাহিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার বাজারে গত সপ্তাহ শেষে সার্বিকভাবে লেনদেনের শীর্ষে ছিল খাদ্য খাত। ডিএসইর মোট লেনদেনের ১৯ শতাংশই ছিল এ খাতের দখলে। আর দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বিমা খাত। ডিএসইর মোট লেনদেনের ১৮ শতাংশই ছিল এ খাতের কোম্পানিগুলোর দখলে।

আলোচ্য সপ্তাহে শেয়ারবাজারে মূল্যবৃদ্ধিতে শীর্ষ ১০ কোম্পানির বেশির ভাগেরই দাম বেড়েছে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই। এ মূল্যবৃদ্ধির কোনো কারণও জানা নেই কোম্পানিগুলোর। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে কিছু কিছু কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটানো হচ্ছে।

ঢাকার বাজারে গত সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসে খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগের শেয়ারের দাম প্রায় ৭ টাকা বা ২৩ শতাংশের বেশি বেড়েছে। অথচ এক বছরের বেশি সময় ধরে কোম্পানিটির উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। রপ্তানিমুখী ব্যাগ তৈরির এই কারখানা বন্ধ করে এখন ভাড়ায় অন্য কোম্পানির জন্য পণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। কিন্তু বাজারে বন্ধ কোম্পানির শেয়ারের দামই বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।


গত এপ্রিলের মাঝামাঝিতেও খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগের শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ফেসভ্যালু বা অভিহিত মূল্যের নিচে। ১৬ এপ্রিল এটির প্রতিটি শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ৯ টাকা ৯০ পয়সা। সেখান থেকে গত তিন মাসে দাম বেড়ে প্রায় চার গুণ হয়েছে। গত সপ্তাহ শেষে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ টাকা ১০ পয়সায়। গত দুই বছরের মধ্যে এটিই কোম্পানিটির শেয়ারের সর্বোচ্চ বাজারমূল্য।

খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজের কোম্পানি সচিব তপন কুমার সরকার সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, রপ্তানিমুখী এই কারখানায় ক্রয়াদেশ না থাকায় এক বছরের বেশি সময় ধরে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। বন্ধ কারখানায় গ্রুপের অন্য কোম্পানির জন্য সাব কন্ট্রাক্টে পণ্য তৈরি করা হচ্ছে।

বন্ধ কারখানাটি কবে চালু হবে, তা নিশ্চিত করতে পারেনি কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাজারে গুজব ছড়িয়েছে যে শিগগিরই কোম্পানিটি ব্যবসা সম্প্রসারণে যাবে। এমন গুজব ছড়িয়ে কারসাজিকারীরা কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে।


বিমায় কেন বাড়তি আগ্রহ
এর আগে ২০২০ সালের জুলাই-আগস্টে বিমা খাতের শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। ওই সময় বিমা খাতের কোনো কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়ে কয়েক গুণ হয়ে যায়। পরে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদন্তে এ মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কারসাজির ঘটনা বেরিয়ে আসে। কারসাজির সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করা হয়। বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিমা খাতের অধিকাংশ কোম্পানিই স্বল্প মূলধনি। ফলে কারসাজিকারীরা এসব শেয়ার বেছে নেন কারসাজির জন্য। কারণ, অল্প শেয়ার কিনে এসব শেয়ারের ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানো যায়।

এ বিষয়ে ইউআইইউর অধ্যাপক মোহাম্মদ মুসা বলেন, বর্তমানে বাজারে ভালো ভালো সব কোম্পানির শেয়ারের দাম ফ্লোর প্রাইসে বা সর্বনিম্ন মূল্য স্তরে আটকে আছে। এমন পরিস্থিতিতে কারসাজিকারীরা স্বল্প মূলধনি কোম্পানিগুলো বেছে নিচ্ছেন দাম বাড়াতে। এ জন্য বাজারে নানা ধরনের গুজবও ছড়ানো হচ্ছে।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বিমা খাতের কোম্পানি রয়েছে মোট ৫৭টি। এর মধ্যে মাত্র ৫টি কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ১০০ কোটি টাকা বা তার বেশি। ১৪টির মূলধন ৫০ কোটি টাকার ওপরে। আর বাকি কোম্পানিগুলোর মূলধন ৫০ কোটি টাকার নিচে।

গত সপ্তাহের বাজার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, মূল্যবৃদ্ধিতে শীর্ষ ১০ কোম্পানির তালিকায় থাকা বিমা খাতের ৬ কোম্পানির শেয়ারের দাম সর্বনিম্ন সাড়ে ২০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৪৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।