কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলা, ঢাবি পরিণত রণক্ষেত্রে

  প্রিন্ট করুন   প্রকাশকালঃ ১৪ জুলাই ২০২৫ ১২:৩৪ অপরাহ্ণ   |   ৩১ বার পঠিত
কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলা, ঢাবি পরিণত রণক্ষেত্রে

ঢাকা, ১৫ জুলাই ২০২৫ (ঢাকা প্রেস):

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দফায় দফায় হামলা চালায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সারাদেশে আহত হন প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী, যার মধ্যে ঢাবিতেই আহত হন অন্তত ২৯৭ জন।

 

এ হামলার সূত্রপাত ঘটে ১৪ জুলাই বিকেলে, যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে কটুক্তি করেন। এতে রাতেই উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগানে ছাত্রী হলসহ বিভিন্ন আবাসিক হল থেকে শত শত শিক্ষার্থী রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হন।
 

পরদিন ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “তারা আত্মস্বীকৃত রাজাকার, এর জবাব ছাত্রলীগই দেবে।” ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন আন্দোলনকারীদের ‘শেষ দেখে নেওয়ার’ হুমকি দেন। এই বক্তব্যের পরই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর সংগঠিত ও স্বশস্ত্রভাবে হামলা শুরু করে ছাত্রলীগ।
 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সামনে প্রথম সংঘর্ষ শুরু হয়। এরপর মধুর ক্যান্টিন ও আশপাশের হলগুলো থেকে ছাত্রলীগ কর্মীরা রড, হকিস্টিক, রামদা ও অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। আতঙ্কিত শিক্ষার্থীরা পালাতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস, হল ও প্রশাসনিক ভবনে আশ্রয় নিলেও সেখানেও হামলা চালানো হয়।
 

হামলায় নারী শিক্ষার্থী, সাধারণ শিক্ষার্থী এবং সাংবাদিকসহ অন্তত তিন শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। বিকেল ও সন্ধ্যায় আহতদের চিকিৎসা নিতে যাওয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটেও হামলা চালানো হয়। শহীদুল্লাহ্ হলের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে।
 

বিক্ষোভকারীদের ভাষ্য
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, “আহতদের ওপর হাসপাতালে পর্যন্ত হামলা করা হয়েছে। পুলিশ কোনো সহযোগিতা করেনি। এটা পরিকল্পিত হামলা।”

 

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পদক্ষেপ
ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে হল প্রাধ্যক্ষদের রাতভর হলে অবস্থানের নির্দেশ দেন। সন্ধ্যার পর ক্যাম্পাসে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। তবে রাত ১০টার পর আবারও ঢাবির বিভিন্ন হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের মোবাইল তল্লাশি ও মারধর শুরু করে। আন্দোলনে জড়িতদের শনাক্ত করে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়।

 

রাজধানী ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা

  • ইডেন মহিলা কলেজ: গেটে তালা দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যোগ দেওয়া ঠেকানো হয়। তালা ভেঙে কিছু শিক্ষার্থী রাজু ভাস্কর্যে মিছিলে অংশ নেন।

  • জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়: পুলিশি বাধা পেরিয়ে শিক্ষার্থীরা ঢাবিতে এসে বিক্ষোভে যোগ দেন। পূর্বে ক্যাম্পাসেই ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে পাঁচজন আহত হন।

  • জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: শাখা ছাত্রলীগ মিছিলের ওপর দফায় দফায় হামলা চালায়। ১৪ জুলাই মধ্যরাতে বহিরাগতদের সঙ্গে নিয়ে অস্ত্রসহ হামলা চালানো হয়; আহত হন অন্তত ৫০ জন।

  • চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: শহীদ মিনার ও কাটাপাহাড় সড়কে ছাত্রলীগের হামলায় ১০ জন আহত হন। চট্টগ্রাম শহরেও সংঘর্ষ হয়।

  • রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: মমতাজ উদ্দিন কলাভবনের সামনে বাম ছাত্র সংগঠনের ওপর হামলায় কয়েকজন আহত হন।

  • যশোর এম এম কলেজ: জেলা প্রশাসকের কার্যালয়মুখী মিছিলে ছাত্রলীগের হামলা।

  • শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়: হামলাকারীদের বিচারের দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান।

  • নতুনবাজার ও কুড়িল বিশ্বরোড: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ।

  • হাবিপ্রবি, কুবি, খুবি, কুয়েট: বিক্ষোভ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
     

সরকারের প্রতিক্রিয়া
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘নিজেদের রাজাকার’ বলার ঘটনাকে “দুঃখজনক” আখ্যায়িত করে বলেন, “তাদের লজ্জাও নেই।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, “এটি সরকারবিরোধী নয়, রাষ্ট্রবিরোধী স্লোগান।”
শিক্ষামন্ত্রী নওফেল বলেন, “এ যুগের রাজাকারদের পরিণতি হবে আগের যুগের রাজাকারদের মতোই।”

 

পরবর্তী কর্মসূচি
১৬ জুলাই (মঙ্গলবার) বিকেল ৩টায় দেশব্যাপী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করছি। তাঁর দুঃখ প্রকাশ করতে হবে।”

সূত্র: বাসস।