প্রকাশকালঃ
১০ জুলাই ২০২৪ ১২:২৭ অপরাহ্ণ ৩৫৭ বার পঠিত
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ২০০৯ সালের পর আর বড় কোনো আন্দোলন করেননি। জাতীয় বেতন স্কেলের সঙ্গে তাঁদেরও বেতন বৃদ্ধি পায়।তবে তাঁদের মূল দাবির প্রতি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সে সময় সরকার শিক্ষকদের ওপর চাপিয়ে দেয় এই নতুন বেতনকাঠামো। আমাদের মনে আছে আমরা যখন স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন আমাদের যুক্তি তুলে ধরেছিলাম, তখন সরকার কর্ণপাত করেনি।
বরং সেই সময়ের অর্থমন্ত্রী তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন, শিক্ষকদের কী দিলাম তা বোঝার ক্ষমতা তাদের নেই। এখন যেমন আমলারা প্রত্যয় স্কিম নিয়ে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। শিক্ষকদের সেই দাবির মূল বক্তব্য ছিল শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশকে সার্বিকভাবে সত্যিকার অর্থে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে হবে, শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো দিতে হবে। শিক্ষাকে পিছিয়ে রেখে যে উন্নতি সম্ভব নয়, সেটা সাদা চোখে বোঝা যায়।
ইউরোপ, কানাডা, আমেরিকা বা আমাদের পাশের দেশের দিকে তাকালেও তা স্পষ্ট বোঝা যায়। বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে বিশ্বব্যাংক যেসব শর্ত দিয়েছিল তার অন্যতম ছিল শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ ব্যয় করতে হবে। সরকার এবং তার সহযোগীরা মিলে আজও সেটা ২ শতাংশ করে রেখেছে। বিশ্বব্যাংক কেন বলেছিল তা তলিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি সরকার।
যার ফল পাচ্ছে গোটা শিক্ষক সমাজ, যারা জাতি গঠনে এবং দেশের উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা পালন করে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদের যে সুযোগ-সুবিধা তা বলার মতো নয়। কয়েক মাস আগে পশ্চিম বাংলার সিধো কানহো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নবীন অধ্যাপককে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখানোর এক পর্যায়ে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার বেতন কত? আমি বিব্রত হই। তিনি অধ্যাপক হিসেবে আমার ১০ বছরের জুনিয়র। আমি সংকোচ করে বললাম, সব মিলিয়ে লাখখানেক পাই।
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, আমিই তো পাই তিন লাখ রুপি। আমি শিক্ষায় সরকারের নানা খরচ, পরিধি, দায়-দায়িত্বের কথা বলে তাঁকে কিছুটা ঠাণ্ডা করেছিলাম। বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে কে কত বেতন পায়, কত আয় করে, কে কী সুবিধা পায় সেদিকে শিক্ষকরা কখনো তাকাতে চান না। যদিও একই দেশে অন্য পেশার সঙ্গে শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার বিস্তর ব্যবধান। তাঁরা অল্পতেই তুষ্ট হয়েছিলেন। বহু মেধাবী শিক্ষক বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটা বেতনে চলে গেছেন।
একসময় অ্যাডমিন ক্যাডার ছেড়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতেন অনেকে, পাকিস্তান আমলেও সেটা হয়েছে। এখন সেটা কল্পনা করা যাবে না। তবু যাঁরা টিকে আছেন, শিক্ষা ও গবেষণার টানে কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁদের আরো নিচে নামিয়ে আনার জন্য সরকার নতুন পরিকল্পনা করেছে। বুদ্ধিদাতা তো অনেক আছেন। আমলারা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, এখানেও নাকি শিক্ষকদের অনেক বেশি সুবিধা দেওয়া হবে। তাহলে আমলারা এখান থেকে বাদ পড়লেন কেন? পারিতোষিক, পেনশন, ইনক্রিমেন্ট, উৎসব ভাতা. পিআরএল সব বাদ দিয়ে কি এটা খুব ভালো ব্যবস্থা? যদি ভালোই হয়, তাহলে আগেরটাই থাক।
গত ১৫ বছরে স্বাধীনতার পক্ষের এই সরকারের কাছে কার্যত শিক্ষার স্থায়ী উন্নতির (শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন, শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো) আশা করেছিল শিক্ষক সমাজ। সেই লক্ষ্যে কার্যত কিছুই করা হয়নি। সরকার নানাভাবে সেই জায়গা থেকে সরে এসেছে। শিক্ষামন্ত্রীরা কখনো কখনো মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন যে তাঁরা কিছু করবেন। বাস্তবে যে কিছু করবেন না সেটা এত দিনে স্পষ্ট হয়েছে।
বরং শিক্ষাকে আরো নিম্নগামী করার জন্য এই প্রত্যয় স্কিম চালু করা হলো। এটা মানা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা স্পষ্ট অবনমন, অপমানকর। শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়ে থাকে সেই মেরুদণ্ড তৈরি করেন শিক্ষকরা, সেখানে উচ্চশিক্ষাকে অবনমিত করে সরকার কোন ধরনের উন্নতি আশা করে?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন রাখতে চাই, তিনি সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিতে বিষয়টাকে বিবেচনা করুন। যাঁরা এই প্রস্তাব দিয়েছেন তাঁরা অবশ্যই এই জাতির শিক্ষার বিষয়ে কোনো মঙ্গল চিন্তা থেকে এটা করেননি। শিক্ষাকে মর্যাদার জায়গায় রাখুন। সবার আগে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো হওয়ার কথা ছিল। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে সেটা হতো বলে আমরা বিশ্বাস করি।