বাংলাদেশের নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি
প্রকাশকালঃ
০১ জুন ২০২৪ ১২:০২ অপরাহ্ণ ৭৪৭ বার পঠিত
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বর্তমানে পঞ্চান্নরও বেশি। চলতি শিক্ষাবর্ষ (২০২৩-২৪) থেকে সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং পিরোজপুর বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। বর্তমানে গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৪। এ ছাড়া রয়েছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে আলাদা একটি গুচ্ছ।
এর বাইরেও রয়েছে একদম নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, যার আইন পাস হয়েছে, কিন্তু শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অনেকগুলো পুরনো এবং প্রতিষ্ঠিত। এগুলোর রয়েছে পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও ভালো মানের শিক্ষক এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু বড় একটি সংখ্যা, আনুমানিক ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চলছে ভাড়া বাসায় কিংবা সরকারি কোনো কলেজ বা স্কুলের অবকাঠামোর একটি অংশ নিয়ে।
কয়েকটি কক্ষ নিয়ে চলছে একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমের সংকট রয়েছে। শিক্ষকদের বসার জন্য আলাদা কক্ষ নেই। শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো লাইব্রেরিও নেই। বেশ দীর্ঘ সময় ধরে এভাবে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এমনকি অনেক শিক্ষার্থী ভাড়া বাসা কিংবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে ক্লাস-পরীক্ষা শেষ করে ডিগ্রি নিয়ে চলে গেছে কিংবা অনেকে যাওয়ার পথে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার যে আনন্দ, তা থেকে তারা পুরোপুরি বঞ্চিত হয়েছে এবং অনেকে হতে চলছে। ফলে শিক্ষণের একটি বড় ঘাটতি এবং অপূর্ণতা রয়ে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষার শিক্ষার্থীরা ক্লাস এবং ক্লাসের বাইরে অনেক কিছু শিখে থাকে। পরিপূর্ণ মানুষ এবং নিজেকে কর্মক্ষেত্র ও সমাজের উপযোগী তৈরি করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় একটি চারণভূমি। কিন্তু সেই ভূমিতে যদি নিজের বিচরণ না হয়, তাহলে শিক্ষণের ঘাটতি তো রয়েই যাবে।
শিক্ষার মানের সঙ্গে শুধু মানসম্মত শিক্ষকই যথেষ্ট নয়, পর্যাপ্ত অবকাঠামো, শিক্ষা উপকরণ, উন্নত লাইব্রেরি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বড় ভূমিকা পালন করে। আমাদের ধারণা, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা বেশির ভাগ উপাদান থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে। তারা না পাচ্ছে অভিজ্ঞ শিক্ষক, না থাকছে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এবং এটি কিভাবে পরিচালিত হবে, তা আইনে পুরোপুরি উল্লেখ থাকে। প্রথমে একজন উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়। অবশ্য অতীতে প্রথমে একজন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হতো, যার কাজ ছিল প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ন্যূনতম অবকাঠামো তৈরি করা। এরপর শিক্ষা কার্যক্রমের দিকে হাত দেওয়া। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান একটি বড় বিষয়।
সরকারের খাসজমি রয়েছে—এমন জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্বাচন করতে পারলে সমস্যা কম হয়। ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়টি দরকার পড়ে না। আবার এমন জায়গা নির্বাচন করাও ঠিক নয়, যেখানে অবকাঠামো নির্মাণ করা কঠিন। যেমন—জায়গা নিচু হলে প্রচুর মাটি ভরাট করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সময় এবং অর্থের প্রচুর অপচয় হয়, যা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অবকাঠামো তৈরি এবং শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে দীর্ঘ করে।
কাজেই একটি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করার সময় থেকেই আমাদের ভাবনায় রাখতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক দিক। অনেক সময় স্থান নির্বাচন নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়। এক পক্ষ চায় একটি স্থানে, তো অন্য পক্ষ এর বিরোধিতা করে। ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে সরকারের প্রশাসন এবং উপাচার্যকে বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। এসব কাজে দীর্ঘ সময় লাগার ফলে আমরা দ্রুত অবকাঠামো তৈরি করতে পারি না।
এখানে দক্ষতার প্রশ্নও রয়েছে। ফলে বছরের পর বছর ভাড়া বাসায় কিংবা সরকারি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। অনেক সময় উপাচার্যরা অসহায় বোধ করেন। কেননা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা কিছু করতে পারেন না। জায়গার বিষয়টি সমাধান করতে পারলে অন্ততপক্ষে দ্রুত একটি অবকাঠামো নির্মাণ করেও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যায়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিজস্বতা থাকে।
আমাদের ছোট দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কম নয়। পাবলিক এবং প্রাইভেট মিলিয়ে এই সংখ্যা প্রায় ১৮০ বা এর কাছাকাছি। আমরা জানি, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারকে কোনো আর্থিক বরাদ্দ দিতে হয় না, কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারের আর্থিক বরাদ্দ শতভাগ। এর মধ্যে অনেক বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেখানে প্রচুর শিক্ষা উপকরণ দরকার হয়। ফলে বরাদ্দের পরিমাণও বাড়ে।
প্রতিবছর নতুন নতুন বিষয় যুক্ত করা হয়। এর ফলেও বরাদ্দ বাড়াতে হয়। আর নতুনগুলোর জন্য বহুবিধ বরাদ্দ দরকার। জমি অধিগ্রহণ, মাটি ভরাট, ভবন নির্মাণ, শিক্ষা উপকরণ নির্বাচন এবং ক্রয় ইত্যাদি। এর মধ্যে বড় একটি খাত অবকাঠামো এবং নতুন নতুন শিক্ষা উপরকণ সরবরাহ। নতুনগুলোর কথাই ধরুন। একেকটিকে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও কত টাকা লাগে।
কাজেই আমরা যদি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকে শিক্ষা ও গবেষণায় এগিয়ে নিতে চাই, তাহলে আসন্ন বাজেটে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া জরুরি। কেননা টাকা ছাড়া অবকাঠামো তৈরি করা সম্ভব নয়। আর অবকাঠামো না হলে সুষ্ঠুভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করাও সম্ভব না। এখানে অন্য একটি বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে। শুধু টাকা থাকলেই চলবে না, টাকা খরচ করার পরিবেশ ও সক্ষমতাও একজন উপাচার্যের থাকতে হবে।
আমরা চাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য অবকাঠামো। আর ভাড়া বাসা কিংবা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম নয়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় অবকাঠামোর বিষয়টি মাথায় রেখে এর শিক্ষা কার্যক্রমের দিকে মনোনিবেশ দিতে হবে। দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্ণধার দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের মনোসামাজিক বিকাশে খোলা মাঠ এবং উন্মুক্ত স্থান থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। উন্নতমানের লাইব্রেরি থাকবে পড়াশোনার জন্য। থাকার জন্য থাকবে মানসম্মত আবাসিক হল। তবেই আমরা তৈরি করতে পারব দক্ষ জনগোষ্ঠী, যা কাজে লাগবে আমাদের দেশে এবং দেশের বাইরে। সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ, অন্যান্য শিক্ষার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার জন্য বিশেষ বরাদ্দ ও গুরুত্ব যেন দেওয়া হয়।