বাঙালি মুসলমানের নাম-বৈচিত্র্য

প্রকাশকালঃ ২৩ মে ২০২৩ ০৪:১৮ অপরাহ্ণ ১৩৭ বার পঠিত
বাঙালি মুসলমানের নাম-বৈচিত্র্য

বাঙালি মুসলমানের নাম খোঁজার আগে বাঙালি মুসলমানের ইতিহাস খোঁজা জরুরি। ঠিক কবে থেকে এ ভূখণ্ডে মুসলমানরা প্রথম এসেছিল তা নিয়ে বিশেষ গবেষণা নেই। বাংলার ইতিহাস নিয়ে নীহাররঞ্জন রায়, সুকুমার সেন প্রমুখের পর এ বিষয়ে গবেষণা-আলোচনার প্রয়োজন বোধ করেননি বাংলাদেশের ইতিহাসবিদরা। ফলে প্রাচীন বাংলায় আরবি মুসলমানদের আগমনের বিষয়টি অন্ধকারেই রয়ে গেছে।

ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে এ দেশে আরব মুসলমানদের যাতায়াত ছিল ইসলামপূর্বকাল থেকেই। যখন ইসলাম আবির্ভূত হয়েছে তখন এ ব্যবসায়ীরাই উপমহাদেশে প্রথম ইসলামকে নিয়ে আসেন। চীনের কোয়াংটা শহরে নবীজি (সা.)-এর মামা আবু ওয়াককাস (রা.)-এর কবর আছে। ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক টিম স্টিলের মতে, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পার ধরে সিকিম হয়ে চীন গিয়েছিলেন তিনি।

যাওয়ার পথে উত্তরবঙ্গে তৈরি করে গিয়েছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম মসজিদ। (পাঠক এ ব্যাপারে বিস্তারিত দেখতে পারেন, প্রথম আলো, ১৯ অক্টোবর ২০১৮-এ প্রকাশিত কাজল রশীদ ও ইফতেখার শাহ মাহমুদের প্রতিবেদন)। এসব থেকে প্রাচীন বাংলায় ইসলাম এবং ধর্মান্তরিত বাঙালি মুসলমানের একটা অস্তিত্ব আমরা অনুমান করতে পারি। কিন্তু কোনো বিশিষ্ট বাঙালি মুসলমানের নাম এ সময়ে পাওয়া যাচ্ছে না।


কারণ প্রাচীন বাংলায় (আনুমানিক ৬০০ শতকে) যেসব আরব মুসলমান ধর্ম প্রচার করেছেন, তাঁরা ১২০০ শতকের বখতিয়ারদের মতো শাসনক্ষমতা দখল করেননি। বাংলার ইতিহাসের শাসককুলের তালিকায় কোনো আরব মুসলমান নেই। যদি সেটা থাকত তাহলে তাদের সঙ্গে থাকা স্থানীয় মুসলমানদের নামের খোঁজ-খবর আমরা পেতাম। হলায়ুধ মিশ্রের শেখ শুভোদয়া গ্রন্থে শেখ জালালউদ্দিন নামে একজন মুসলমানের নাম পাওয়া যায়। কিন্তু শেখ জালাল বাঙালি ছিলেন না।

‘জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’-এর একটি সংখ্যায় মুন্সীগঞ্জ জেলার রামপালের কানাইচং নামক গ্রামের একজন মুসলমানের কথা আছে, যে রাজা বল্লাল সেনের আমলে মক্কা গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর নামটি ইতিহাসে পাওয়া যায় না। যদি পাওয়া যেত, তাহলে তিনিই হতেন প্রথম সাধারণ বাঙালি মুসলমান। শাসকদের মধ্যে প্রথম বাঙালি মুসলমান হচ্ছেন রাজা জালালউদ্দিন মুহম্মদ। তিনি ছিলেন রাজা গণেশের পুত্র (১৪১৬-১৪১৭)।

কবিদের মধ্যে প্রথম বাঙালি মুসলমান হিসেবে যাঁর নাম পাওয়া যায় তিনি হচ্ছেন শাহ মুহম্মদ সগীর (১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে)। মধ্যযুগের কাব্য মনসামঙ্গল কাব্যে দুজন মুসলমানের নাম আছে, হাসান ও হোসেন। কিন্তু তাঁরা বাঙালি নন, তুর্কি মুসলমান। তবে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয় রয়েছে বখতিয়ার, ইখতিয়ার, গিয়াসউদ্দিন, ইলিয়াস, শামসুদ্দিন, নাসিরউদ্দিন, রোকন, আলাউদ্দিন, জালাল, বাবর, হুমায়ুন, আকবর, আলমগীর মোর্শিদ, সিরাজ, ফিরোজ, আজম প্রভৃতি নাম। যা মূলত বিভিন্ন সময়ে বাংলার রাজা-বাদশাহদের নাম। বাংলার বাইরের বাদশাহ হারুন রশিদের নামও জনপ্রিয় মুসলমানদের মধ্যে। তুর্কি শাসক কামাল আতাতুর্কও বাঙালি মুসলমানের কাছে প্রিয় নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছেন। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক দিন ক্ষমতাসীন ছিলেন শেরশাহ; তাঁর নামে বাঙালি মুসলমানের নাম নেই। মেয়েদের নামে মোগল বধূ নূরজাহান এবং তাঁর মেয়ে আরজুমন্দ সমান জনপ্রিয়।


অবশ্য মুসলমানরা কেমন নাম রাখবে তার একটা পথ-নির্দেশিকা কোরআন-হাদিসে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুরা হাশরে আল্লাহ বলেছেন, ‘সব সুন্দর নাম আল্লাহরই।’ (সুরা হাশর, আয়াত : ২৪)

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘আর সুন্দর নামগুলো আল্লাহরই। তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাকবে।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ১৮০)

আবু দারদা (রা.) জানিয়েছেন, ‘রাসুলে পাক (সা.) একদিন বলেন, ‘কিয়ামতের দিন তোমাদের ডাকা হবে তোমাদের ও তোমাদের পিতাদের নামে (অমুকের ছেলে অমুক)। তাই তোমরা নিজেদের জন্য সুন্দর নাম রাখো।’ (আবু দাউদ, হাদিস, নম্বর ৪৯৫০)


ইসলামে জন্মের সাত দিনের মধ্যেই সন্তানের নাম রাখার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। একবার এক ব্যক্তি দরবারে হাজির হলে নবীজি (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী? সে বলল, ‘হাজন’। নবীজি তার নাম পাল্টে রাখলেন ‘সাহল’।  (বুখারি, হাদিস নম্বর : ৫৮৪০)

এখানে ‘হাজন’ অর্থ ছিল ‘শক্ত’ আর ‘সাহল’ অর্থ নরম। অতএব, অর্থবোধক নাম রাখারও প্রয়োজন দেখিয়েছে ইসলাম।

আরবি শব্দবিশিষ্ট হলেও অর্থ জেনে নাম রাখতে হবে। শুনতে ভালো লাগলেই হবে না। ‘খায়রুল বাশার’ শুনতে তো ভালোই লাগে। অর্থ ‘সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ’। এ রকম নাম ইসলাম পছন্দ করে না। কারণ এতে অহংকার প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। আবার ‘আবুল বাশার’ হচ্ছেন ‘মানব জাতির পিতা’। কী রকম নাম হলো এটা! সমাজে অনেক খলিলউল্লাহ, কলিমউল্লাহ পাবেন। খলিলউল্লাহ উপাধি পেয়েছিলেন ইব্রাহিম (আ.)। কারণ তিনি আল্লাহর বন্ধু ছিলেন। আর কলিমউল্লাহ ছিল মুসা (আ.)-এর উপাধি। কারণ তিনি আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। আমাদের কলিমউল্লাহ কি আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছিলেন, খলিলউল্লাহ যারা, আল্লাহর সঙ্গে বন্ধুত্ব তাদের কিভাবে হলো!


আসলে সন্তানের নাম রাখার মধ্যেও অভিভাবকের রুচি ও মননশীলতা ধরা পড়ে। নামকরণ হবে যুগপৎ, অর্থবোধক ও সুন্দর। ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’ প্রবাদ আমাদের সমাজে পূর্ব থেকেই আছে। অনেক মেয়ের নাম ‘কামরুন্নাহার’। অর্থ দিনে চাঁদের আলো। ‘শামসুন্নাহার’ অর্থ দিনে সূর্যের আলো। দিনে তো চাঁদের আলো থাকে না। দিনে সূর্যের আলো, অর্থের দিক ঠিক থাকলেও সূর্য পুরুষবাচক শব্দ, এ দিয়ে মেয়ের নাম হয় না।

আল্লাহ ও রসুল (সা.)-এর নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখার ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। মহান আল্লাহর রয়েছে সুন্দর সুন্দর গুণবাচক শত শত নাম। তবে এসব নামের আগে-পরে দাসসুলভ কিছু শব্দ থাকতে হবে। যেমন ‘খালেক’ নাম রাখলে আগে ‘আবদুল’ যুক্ত করা প্রয়োজন। ‘আবদুল খালেক’ অর্থ হবে সৃষ্টিকর্তার দাস। আবার পরে ‘জামান’ যুক্ত হয়ে ‘খালেকুজ্জামান’ও করা হয়। অর্থ হবে ‘সময়ের সৃষ্টিকারী’। কিন্তু মানুষ তো সময়ের সৃষ্টিকারী নয়। শুধু শুধু ‘খালেক’ বলে ডাকাও যাবে না। একজন কারো বাসায় গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘খালেক আছে?’ জবাব এলো, ‘খালেক নাই’। অর্থ হলো, সৃষ্টিকর্তা নেই। তাই সতর্কতা। আবদুর রহমান, গোলাম রহমান এভাবেও রাখা যায়। কিন্তু ‘গোলাম রসুল’, ‘গোলাম মোস্তফা’, ‘গোলাম মোহাম্মদ’, ‘গোলাম আলী’ রাখা যাবে না। কারণ এখানে অর্থ হচ্ছে রসুলের গোলাম, মোহাম্মদের গোলাম, আলীর গোলাম। সেটা তো ইসলামের দৃষ্টিতে একপ্রকার শিরক, যা আল্লাহর কাছ থেকে মাফ হবে না।

পাশাপাশি বাঙালি মুসলমানের গ্রামীণ জীবনে এখনো রয়ে গেছে শত শত লোকজ নাম। কবি নজরুলের শৈশবে নাম ছিল দুখু মিয়া। জেনারেল এরশাদের শাসনামলে একজন ডেপুটি স্পিকারের নাম ছিল ভোলা মিয়া। এ রকম কালামিয়া, কালু, চান্দু, ব্যাঙ্গা, বল্টু, নান্নু, ক্ষুদু, দুদু, টুক্কু, গোল্লা, পুঁটি, কটা, এন্তা, ধলা, মনা, কুটু, সোনা, নোয়া, আলতু, ক্ষতি, ট্যাংরা, ভুট্টো, জুরন, ডোকল, বছা, পাচু, ডেমা ইত্যাদি নামের রেশ গ্রামবাংলায় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। ইহুদি-খ্রিস্টানদের মধ্যেও এ রকম হরেক রকমের নাম আছে। যেমন বিবিসির টোকিও প্রতিনিধি ছিলেন ফিলিপ শর্ট  (খাটো অর্থে), বিবিসির আবহাওয়ার খবর পড়তেন মাইকেল ফিশ (মাছ), আরেকজন উপস্থাপক ছিলেন জন কেটলি (চায়ের পাত্র)। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ সফররত ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের একজন খেলোয়াড় আছেন, যাঁর নাম ‘সল্ট’ (লবণ)। (অসমাপ্ত)