রাজনৈতিকভাবে কুমিল্লা জেলা ‘কুমিল্লা উত্তর’ ও ‘কুমিল্লা দক্ষিণ’—এই দুই ভাগে বিভক্ত। উত্তরে ৫টি ও দক্ষিণে ৬টি আসন রয়েছে। জেলার রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থি দলের প্রভাব দীর্ঘদিনের।
আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে কুমিল্লার রাজনৈতিক মাঠে ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। মাঠপর্যায়ের প্রস্তুতি, আগাম প্রার্থী ঘোষণা ও নিয়মিত গণসংযোগের কারণে জামায়াতে ইসলামী প্রায় সব আসনেই সক্রিয় অবস্থান তৈরি করেছে। অন্যদিকে প্রাথমিক মনোনয়নকে কেন্দ্র করে বিএনপিতে একাধিক আসনে বিভক্তি দেখা দেওয়ায় দলটির নির্বাচনী প্রস্তুতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী কুমিল্লার ১১টি সংসদীয় আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করে ইতোমধ্যে পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করেছে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রার্থীরা নিয়মিত পথসভা, উঠান বৈঠক, লিফলেট বিতরণ ও বাড়ি বাড়ি গণসংযোগ চালাচ্ছেন। শহর ও গ্রাম—উভয় এলাকাতেই জামায়াতের উপস্থিতি দৃশ্যমান হচ্ছে।
অন্যদিকে বিএনপিতে প্রাথমিক মনোনয়ন ঘোষণার পর একাধিক আসনে অসন্তোষ প্রকাশ্যে এসেছে। মনোনয়ন বঞ্চিত নেতাকর্মীদের একটি অংশ অনেক জায়গায় নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কোথাও কোথাও আলাদা গ্রুপিং তৈরি হওয়ায় দলীয়ভাবে সমন্বিত প্রচার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি-মেঘনা)
এই আসনে জামায়াতে ইসলামী নিয়মিত গণসংযোগ ও উঠান বৈঠকের মাধ্যমে অবস্থান শক্ত করছে। দলটির প্রার্থী মো. মনিরুজ্জামান বাহলুল এলাকায় পরিচিত মুখ। অন্যদিকে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকায় এলাকায় উপস্থিত হতে পারছেন না, যা ভোটের মাঠে
প্রভাব ফেলছে বলে স্থানীয়দের মন্তব্য।
কুমিল্লা-২ (হোমনা-তিতাস)
জামায়াত সাংগঠনিক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। বিএনপিতে মনোনয়ন নিয়ে অসন্তোষ ও গ্রুপিংয়ের কারণে মাঠপর্যায়ের তৎপরতা কমেছে। এ আসনে জামায়াত প্রার্থী নাজিম উদ্দিন মোল্লা নিয়মিত প্রচারণা চালাচ্ছেন।
কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর)
দীর্ঘদিন একই নেতৃত্বের কারণে ভোটারদের মধ্যে রাজনৈতিক ক্লান্তির কথা শোনা যাচ্ছে। বিএনপির প্রার্থী কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেইন কায়কোবাদের বিপরীতে জামায়াত প্রার্থী ইউসুফ হাকিম সোহেল কেন্দ্রভিত্তিক গণসংযোগ জোরদার করেছেন।
কুমিল্লা-৪ (দেবীদ্বার)
এ আসনে জামায়াত প্রার্থী সাইফুল ইসলাম শহিদ আগেভাগেই মাঠে সক্রিয় ছিলেন। বিএনপিতে মনোনয়ন বঞ্চিতদের একটি অংশ নিষ্ক্রিয় থাকায় দলীয় প্রচারণা ব্যাহত হচ্ছে বলে জানা গেছে।
কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া)
বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও প্রার্থীকে ঘিরে অভিযোগের কারণে প্রচারণা প্রত্যাশিত গতি পাচ্ছে না। জামায়াত প্রার্থী ড. মোবারক হোসেন সংগঠিত প্রচারণা চালাচ্ছেন।
কুমিল্লা-৬ (সদর-সদর দক্ষিণ)
এই আসনটি বরাবরই বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। তবে মনোনয়ন নিয়ে বিভক্তি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সম্ভাবনায় দলটি চাপে রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী মহানগর পর্যায়ে প্রচারণা জোরদার করেছে।
কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা)
এখনো বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা না করায় মাঠে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এ আসনে সক্রিয় রয়েছে।
কুমিল্লা-৮ (বরুড়া)
বিএনপির প্রচারণা তুলনামূলকভাবে সীমিত। জামায়াত প্রার্থী ড. শফিকুল আলম হেলাল নিয়মিত গণসংযোগ চালাচ্ছেন।
কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ)
বিএনপি একাধিক গ্রুপে বিভক্ত বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। জামায়াত প্রার্থী ড. সরওয়ার উদ্দিন ছিদ্দিকী সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করেছেন।
কুমিল্লা-১০ (লালমাই-নাঙ্গলকোট)
বিএনপির মনোনয়ন ঘিরে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ও আন্দোলনের কারণে দলটি চাপের মুখে। জামায়াত প্রার্থী ইয়াছিন আরাফাত মাঠে সক্রিয় রয়েছেন।
কুমিল্লা-১১ (চৌদ্দগ্রাম)
ঐতিহাসিকভাবে জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসনে দলটির হেভিওয়েট প্রার্থী ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের নিয়মিত সমাবেশ ও গণসংযোগ করছেন। বিএনপি প্রার্থীও প্রচারণা চালাচ্ছেন, তবে মাঠে দৃশ্যমানতা তুলনামূলক কম বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
সব মিলিয়ে কুমিল্লার অধিকাংশ আসনে নির্বাচনী লড়াই নির্ভর করছে মাঠপর্যায়ের সক্রিয়তা ও দলীয় ঐক্যের ওপর। আগেভাগে প্রার্থী চূড়ান্ত করে সংগঠিতভাবে মাঠে নামার সুবিধা নিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। বিপরীতে বিএনপি যদি অভ্যন্তরীণ বিভক্তি কাটিয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রচারণায় যেতে না পারে, তাহলে জেলার একাধিক আসনে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা।