মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে সরকার
প্রকাশকালঃ
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০২:১১ অপরাহ্ণ ৩০৮ বার পঠিত
গড় মূল্যস্ফীতি এখন ৯ শতাংশ হলেও যাঁদের আয় সীমিত, তাঁদের কাছে মূল্যস্ফীতির হার হবে দ্বিগুণেরও বেশি। অথচ সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল তা ৬ শতাংশের নিচে রাখা হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এই ব্যর্থতার দায়ভার সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপরেই বর্তায়।
দেশের মূল্যস্ফীতি তাপমাত্রার মতো। কাগজে-কলমে যতটা, অনুভূত হয় আরও বেশি। গড় মূল্যস্ফীতি এখন ৯ শতাংশ হলেও যাঁদের আয় সীমিত, তাঁদের কাছে মূল্যস্ফীতির হার হবে দ্বিগুণেরও বেশি। অথচ সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল তা ৬ শতাংশের নিচে রাখা হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এই ব্যর্থতার দায়ভার সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপরেই বর্তায়। জবাবদিহি কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই করতে হবে।
সরকার ও সাধারণ মানুষের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জবাবদিহির কিন্তু অসংখ্য উদাহরণ আছে। কেননা নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতি একদিকে যেমন একটি সরকারকে অজনপ্রিয় করে, অন্যদিকে সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষ থাকে চরম কষ্টে। ফলে মানুষের জানার অধিকার আছে, কেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা গেল না? আর সাধারণ মানুষ যাতে জানতে পারে, সে কারণেই বিভিন্ন দেশ আইন করে সেই ব্যবস্থাও রেখেছে।
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই জবাবদিহির একটা নির্দিষ্ট কাঠামো আছে। যেমন ভারতে আরবিআই অ্যাক্ট ৪৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক ইন্ডিয়া (আরবিআই) যদি পরপর তিন প্রান্তিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় তাহলে আনুষ্ঠানিকভাবে কেন্দ্রীয় সরকারকে লিখিত প্রতিবেদন দিতে হয়। সেই প্রতিবেদনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কর্মপরিকল্পনা এবং কত দিনের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, তার সম্ভাব্য সময়সীমাও লিখে দিতে হয়। ব্যর্থ হওয়ার ঠিক এক মাসের মধ্যে আরবিআই গভর্নর এই চিঠি লিখতে বাধ্য।
একইভাবে জবাবদিহির অংশ হিসেবে মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে না থাকলে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর ও অর্থমন্ত্রীর মধ্যে খোলা চিঠি বিনিময় হতে হয়। সেই চিঠিতে গভর্নরকে জানাতে হয় কেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। একই সঙ্গে লক্ষ্য পূরণে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা-ও বলতে হবে। এই চিঠি আবার গোপন করা যাবে না, ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।
এমনকি ফিলিপাইনের মতো দেশেও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে দেশের প্রেসিডেন্ট ও দেশের মানুষের উদ্দেশে খোলা চিঠি লিখতে হয়, যা তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। জ্যামাইকার গভর্নরকেও মুদ্রানীতি ঘোষণার আগেই দেশটির অর্থমন্ত্রীকে প্রস্তাবিত নীতির কথা জানিয়ে চিঠি লিখতে হয়। জ্যামাইকার আইনেই এই চিঠি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশের কথা বলা আছে।
একই ধরনের চিঠি লিখতে হয় কানাডার কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরকেও। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য এবং তা অর্জনের কৌশল নিয়ে প্রতি পাঁচ বছর পর কানাডা সরকার ও কানাডার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে যৌথ সম্মতিপত্রে সই করতে হয়। এ নিয়ম অনুযায়ী লক্ষ্য অর্জন হচ্ছে কি না, তা নিয়ে জবাবদিহি করতে হয় গভর্নরকে। তুরস্কেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইন কেন মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য অর্জন করা গেল না এবং ভবিষ্যতে কী করা হবে, তা নিয়ে সরকারের উদ্দেশ্যে গভর্নরকে প্রতিবেদন দিতে হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, জবাবদিহি কেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকেই করতে হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির অধ্যায় শুরু হয়েছিল ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে, যা অব্যাহত থাকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দায়দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর ন্যস্ত হয়েছে মূলত এর পর থেকেই। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য নির্ধারণ বা ইনফ্লেশন টার্গেটিং বিষয়টিও তখন থেকেই শুরু। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির হার নির্ধারণ করেই মুদ্রানীতি তৈরি করা শুরু হয়। এই কাজটি প্রথম করেছিল নিউজিল্যান্ড। ১৯৯৭ সালের মন্দার পর থেকেই অন্যান্য দেশও এই নীতি অনুসরণ করে আসছে। বেশির ভাগ দেশেরই লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি ২ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে রাখা।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসার আগে তুরস্ক নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান অর্থনীতির মৌলিক রীতিনীতি এমনিতেই তেমন মানেন না। বিশ্ব অর্থনীতির এই সংকটের সময়ও তিনি ক্রমাগতভাবে সুদহার কমিয়েছেন। আর এর ফলও পেয়েছিলেন হাতেনাতে। ২০২২ সালে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয় ৮৫ শতাংশ। ফলে এরদোয়ানকেও অবশেষে মৌলিক অর্থনৈতিক নীতির কাছে নতি স্বীকার করতে হয়। নতুন করে নির্বাচিত হয়ে আসার পর গত জুনে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর পরিবর্তন করেন। সাবেক ওয়ালস্ট্রিট ব্যাংকার হাফিজ এরকান গভর্নর হয়েই সুদহার বাড়ানোর নীতি নেন। গত আগস্টেই বেশ বড় আকারে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে কিন্তু তুরস্কের মিল আছে। এখানেও সুদহার না বাড়ানোর পণ নিয়ে বসেছিলেন দেশের নীতিনির্ধারকেরা। একশ্রেণির ব্যবসায়ীকে খুশি করতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সুদহার ৯ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশও নীতি পরিবর্তনে বাধ্য হতে হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে সুদহার। তবে তুরস্কের মতোই অনেক দেরিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকা মূল অস্ত্র হচ্ছে মুদ্রানীতির কার্যকর ব্যবহার। অর্থাৎ সুদহার বাড়িয়ে বা কমিয়ে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই কাজ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিভাগ। প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হচ্ছে বিভাগটি। মুদ্রানীতি তৈরি করার সব কেন্দ্রীয় ব্যাংকেই আছে একটি মুদ্রানীতি কমিটি। এখানেও ব্যতিক্রম বাংলাদেশ।
ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের মনিটারি পলিসি কমিটি বা মুদ্রানীতি কমিটির সদস্য ৯ জন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর অ্যান্ড্রু বেইলি এর প্রধান। কমিটিতে চারজন রয়েছেন বাইরের বিশেষজ্ঞ। চারজনই অর্থনীতিবিদ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, গবেষক হিসেবেও খ্যাতি আছে।
থাইল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি কমিটির সদস্য সাতজন। গভর্নর ও দুই ডেপুটি গভর্নরের বাইরে বাকি চারজন বাইরের বিশেষজ্ঞ। ব্যাংক অব থাইল্যান্ডের ওয়েবসাইটেই লেখা আছে, গভর্নরের দায়িত্ব মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা, তবে সেই নীতিতে ভারসাম্য আনার কাজটি করেন বাইরের চারজন বিশেষজ্ঞ। এই কমিটি বছরে ছয়বার বৈঠকে বসে মুদ্রানীতির কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা করে।
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি কমিটির সদস্য ছয়জন। গভর্নর এর প্রধান, দুজন সদস্য হচ্ছেন বাইরের দুই বিশেষজ্ঞ। শ্রীলঙ্কার মুদ্রানীতি কমিটিতে বাইরের বিশেষজ্ঞ কেউ নেই। তবে স্টেকহোল্ডার এনগেজমেন্ট কমিটি (এসইসি) নামে তাদের একটি কমিটি আছে। এ কমিটিতে অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা থাকেন। সেখানেই মুদ্রানীতি নিয়ে নিয়মিত পর্যালোচনা হয়। মালয়েশিয়ার মুদ্রানীতি কমিটিতেও বাইরের দুজন অর্থনীতিবিদ আছেন। এমনকি নাইজেরিয়ার মুদ্রানীতি কমিটির ১২ সদস্যের মধ্যে চারজনই বাইরের বিশেষজ্ঞ।
বাংলাদেশ ব্যাংকেও একটি মুদ্রানীতি বিভাগ আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে বলা আছে, এই বিভাগ গভর্নরের নির্দেশ অনুযায়ী প্রতি মাসে একবার অথবা প্রতি প্রান্তিকে অন্তত একবার মুদ্রানীতি কমিটির বৈঠকের আয়োজন করবে। এ মুদ্রানীতি কমিটির সদস্য গভর্নর, চার ডেপুটি গভর্নর, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং মুদ্রানীতি বিভাগের নির্বাহী পরিচালক। অর্থাৎ বাইরের কেউ নেই। সুতরাং অর্থনীতিবিদ বা বিশেষজ্ঞদের কোনো স্থান নেই বাংলাদেশ ব্যাংকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালিত হয় বাংলাদেশ ব্যাংক আইন অনুযায়ী। এই আইনের ৩৮এ ধারায় বলা আছে, গভর্নরকে অবশ্যই বছরে একবার অর্থ মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে উপস্থিত হয়ে মুদ্রানীতি নিয়ে রিপোর্ট উপস্থাপন করতে হবে। আইনে ‘শ্যাল’ কথাটির উল্লেখ আছে, অর্থাৎ এটি অবশ্যই পালনীয়। বাংলাদেশের চিত্র অবশ্য দুই দিক থেকেই ব্যতিক্রম। কেননা, অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি নিজেরাই নিয়মিত বৈঠক করে না। জাতীয় সংসদে উত্থাপিত কোনো বিল নিয়ে আলোচনা করা ছাড়া এ কমিটির কোনো বৈঠকই হয় না। সুতরাং মুদ্রানীতি নিয়ে আলোচনারও কোনো সুযোগ হয় না।
অন্যের মতামত শোনা বা জবাবদিহি করার কোনো চর্চা আমাদের এখানে এমনিতেই নেই। এখানে একেক সময় একেক নীতি নেওয়া হচ্ছে, আবার তা বদলে ফেলা হচ্ছে। আবার কোন নীতি কম কাজ করবে, তা নিয়েও নেই কোনো গবেষণা। এর ফলে অর্থনীতি কতটা সংকটে পড়তে পারে, তার উদাহরণ সবাই এখন খালি চোখেই দেখতে পাচ্ছেন। এতে সাধারণ মানুষকেই দুর্ভোগ বেশি পোহাতে হচ্ছে। সুতরাং এর দায় কার, আর কত দিন দুর্ভোগ থাকবে এবং সামনে কী পরিকল্পনা, এর একটা জবাব সাধারণ মানুষের পাওয়ার অধিকারের মধ্যেই পড়ে। প্রশ্ন হচ্ছে এ জবাব কে দেবেন? কে নেবেন এর দায়?