প্রকাশকালঃ
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৪:৪২ অপরাহ্ণ ২১৯ বার পঠিত
মূল্যস্ফীতি যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে ধারাবাহিকভাবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়নের পাশাপাশি মুদ্রার দরপতনের হার কমাতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করলেও বাংলাদেশে কমছে না। খোদ পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম গত মঙ্গলবার বলেছেন, মূল্যস্ফীতির হার আগের পর্যায়ে নামতে এক বছর সময় লাগবে।
এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক ওয়ার্কিং পেপার বা কার্যপত্রে যা বলা হয়েছে, তা রীতিমতো আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার শামিল। তারা বলেছে, আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হলে ধারাবাহিকভাবে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি প্রণয়নের পাশাপাশি দেশীয় মুদ্রার দরপতনের হার কমাতে হবে।
আইএমএফের কার্যপত্রে বাংলাদেশ সম্পর্কে অবশ্য সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা নেই। তবু এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশ উল্লিখিত দুটি ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে আছে। বাস্তবতা হলো, ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি ডলারের আন্তব্যাংক বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা, যা এখন ১১০ টাকা; অর্থাৎ এই সময়ে স্থানীয় টাকার দরপতন হয়েছে ২৮ দশমিক ২১ শতাংশ। এর মধ্যে নীতি সুদহার বাড়ানো হলেও ব্যাংকঋণের সুদহার অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৯ শতাংশেই রয়ে গেছে। ফলে নীতি সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব তেমন একটা অনুভূত হয়নি, অন্তত এখন পর্যন্ত।
মুদ্রানীতি সংকোচন করে মূল্যস্ফীতির রাশ টানা জরুরি, তা না হলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভারসাম্য আসবে না।
মোস্তাফিজুর রহমান, বিশেষ ফেলো, সিপিডি
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে মুদ্রার বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে ধরে রেখেছিল। যে কারণে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যখন ডলারের বিনিময় হার অনেকটা বৃদ্ধি পায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। এটি মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ। যদিও এখন বিশ্লেষকেরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি কেবল বৈশ্বিক কারণে হচ্ছে না, নিজস্ব বাজার ব্যবস্থাপনাও এর জন্য দায়ী।
বাস্তবতা হচ্ছে, গত জুন ও জুলাই মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমার পর আগস্ট মাসে তা আবার বেড়েছে। গত মাসে (আগস্ট) মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। এই সময় দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হঠাৎ অনেকটা বেড়ে গেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার উঠেছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে।
সরকারের প্রত্যাশা ছিল, আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতির হার কমবে। ২৯ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভার (একনেক) পর পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘মূল্যস্ফীতি জোর করে কমানো যায় না। কার্যকর নীতি নিতে হবে। আমি ঝুঁকি নিয়ে বলতে পারি, চলতি আগস্টে মূল্যস্ফীতি ২ থেকে ৪ পয়েন্ট কমবে।’ কিন্তু গত মাসে তা উল্টো বেড়েছে।
১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত আইএমএফের ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইনফ্লেশন শকস: সেভেন স্টাইলাইজড ফ্যাক্ট’ শীর্ষক একটি ওয়ার্কিং পেপার বা কার্যপত্রে ১৯৭০ সালের বিশ্বের ৫৬টি দেশের মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও আর্থিক সংকটের মতো বিষয়গুলোও এতে আমলে নেওয়া হয়। বলা হয়েছে, এই দেশগুলোর মধ্যে ৬০ শতাংশ দেশে মূল্যস্ফীতির হার পাঁচ বছরের মধ্যে কমানো সম্ভব হয়েছে। যারা এ কাজে সফল হয়েছে, তাদেরও গড়ে তিন বছরের বেশি সময় লেগেছে।
আইএমএফের ওয়ার্কিং পেপারে বলা হয়েছে, অনেক দেশে এমন দেখা গেছে যে মূল্যস্ফীতির হার সাময়িকভাবে কমার পর আবার বেড়েছে। আবার কমেছে মানে, তা আগের পর্যায়ে নেমে গেছে তা নয়, বরং উচ্চ হারে স্থিতিশীল হওয়ার পর আবারও বেড়েছে। যেসব দেশে মূল্যস্ফীতি সামলানো গেছে, সেখানে ধারাবাহিকভাবে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হয়েছে।
সেই সব দেশে মূল্যস্ফীতি সমন্বয় ব্যতীত মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল কম, মুদ্রার দরপতনের হারও ছিল কম। এই প্রক্রিয়ায় সেখানে স্বল্প মেয়াদে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমেছে, তবে পাঁচ বছরের মেয়াদে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেনি। সেই সঙ্গে তাদের কর্মসংস্থান ও প্রকৃত মজুরি কমেনি। নীতির ধারাবাহিকতা ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে এটা অর্জন সম্ভব বলে মনে করে আইএমএফ।
এই পরিস্থিতিতে আইএমএফ মনে করছে, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই হবে দীর্ঘমেয়াদি। আগামী কয়েক বছর সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ও কঠোর রাজস্বনীতি গ্রহণ করতে হবে; অর্থাৎ সমাজে মুদ্রার সঞ্চালন কমানোর পাশাপাশি সরকারি ব্যয় কমাতে হবে; মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমলেই মুদ্রানীতির রাশ না ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছে তারা।
আগস্ট মাসে প্রকাশিত আইএমএফের আরেক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, নীতি সুদহার এক শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানো হলে প্রথম বছর মূল্যস্ফীতির হার কমে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট। তাই নীতি সুদহার আরও বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হলে প্রবৃদ্ধির হার কমে যায় বা বেকারত্বের হার বেড়ে যায়। আইএমএফের ওয়ার্কিং পেপারের ভাষ্য, জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া সাময়িক, যেসব দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে, সেখানে এটা দেখা গেছে।
এদিকে চলতি বছরের দ্বিতীয় ভাগের মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমানোর কথা বলেন। মূল্যস্ফীতির হার ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেন তিনি। সেদিন তিনি আরও বলেন, সরকার যে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিয়েছিল, সেটা তেমন একটা কাজে আসেনি। ব্যাংকঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ থাকার কারণে ঋণ নেওয়া এখনো অনেক সহজ। তাঁর মতে, ব্যাংকঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করা হলে ঋণ নেওয়া কঠিন হবে এবং তাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।
বাংলাদেশ কী করতে পারে
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মুদ্রানীতি সংকোচন করে মূল্যস্ফীতির রাশ টানা জরুরি, তা না হলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভারসাম্য আসবে না। সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে প্রথমে কিছুটা ধাক্কা লাগবে তা ঠিক, কিন্তু অর্থনীতি ধীরে ধীরে এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে। সমস্যা হচ্ছে, এসব না করলে যে বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে, তা-ও নয়; দীর্ঘ মেয়াদে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বিনিয়োগ উল্টো নিরুৎসাহিত হবে। তার চেয়ে বরং প্রথমে কিছুটা ধাক্কা সহ্য করে হলেও সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা প্রয়োজন। আবার নীতি সুদহার বাড়িয়ে বাণিজ্যিক ঋণের সুদহারের সীমা রেখে দিলে চলবে না, সেটিও বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।
মুদ্রার বিনিময় হার প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মুদ্রার বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে ধরে রেখে লাভ হয় না, সেটা দেখা গেল। এটাও বাজারে ওপর ছেড়ে দিতে হবে। এতেও প্রথমে ধাক্কা লাগবে; অর্থাৎ দর আরও কিছুটা কমে যাবে। এসব কাজ করে ফেলতে হবে, তাহলে বাজার বিষয়টির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। তিনি মনে করেন, নীতিগত ব্যবস্থা না নিয়ে বাজারে অভিযান চালিয়ে লাভ হবে না। কারণ, মূল বিষয় হলো চাহিদা ও জোগান।
আইএমএফের কার্যপত্রে আরও বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে চলমান লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হবে। এই প্রক্রিয়ায় সময়ের আগেই মুদ্রানীতির রাশ ছেড়ে দেওয়া হলে মূল্যস্ফীতির হারও উল্টো বাড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, নীতি সুদহার রেকর্ড হারে বাড়ানোর পরও সেখানে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে তেমন প্রভাব পড়েনি; বরং বেকারত্বের হার রেকর্ড পরিমাণ নিচে নেমে এসেছে। বিশ্লেষকেরা বলেন, এটা মূলত দেশটির প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার কারণে ঘটেছে। তাদের বাজার উচ্চ নীতি সুদহারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছে, সেই সময়ও তারা পেয়েছে। তাই সময়মতো নীতিগত ব্যবস্থা নেওয়া বা সংস্কার জরুরি বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
মূল্যস্ফীতিকে বলা হয় নীরব ঘাতক। এর কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায় এবং পরিণামে জীবনচক্রেও প্রভাব পড়ে। সে জন্য দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকা উদ্বেগজনক বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
বিশ্লেষকেরা বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা উচিত। সরকার পারিবারিক কার্ডের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে যে খাদ্যপণ্য বিক্রি করছে, তার প্রাপ্তি ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার পাশাপাশি ব্যাপ্তি বাড়ানো যেতে পারে। তাহলে বাজারের ওপর চাপ কিছুটা কমবে। সীমিত আয়ের মানুষেরা একটু স্বস্তি পাবেন।