অর্থ ও শারীরিক পরিশ্রমের সমন্বয়ে একটি শ্রেষ্ঠতম ইবাদতের নাম হজ। একজন মুসলমানের সারা জীবনের চাওয়া-পাওয়া আর স্বপ্নের অন্যতম অধ্যায় এই হজ। কেননা হজ একটি বিরল সৌভাগ্যমণ্ডিত ইবাদত। সবার কপালে জোটে না।
হাজারো মানুষ এমন আছে যাদের আর্থিক সামর্থ্য থাকার পরও হজ করার সৌভাগ্য হয় না। আবার কারো আর্থিক সামর্থ্য না থাকলেও শুধু ভাগ্যগুণে সে আল্লাহর ঘরের মেহমান হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে। চলতি মৌসুমে বাংলাদেশ থেকে হজে যেতে জনপ্রতি মোটা অঙ্কের টাকা সংগ্রহ করতে হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল এ দেশের বেশির ভাগ জনগোষ্ঠীর কাছে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ রীতিমতো অকল্পনীয় ব্যাপার।
তাইতো স্বপ্ন পূরণের বিরল সুযোগ হিসেবে যার নসিবে সৌভাগ্যের এ সিতারা উঁকি দেয় তার উচিত প্রভুপ্রেমে পাগল হয়ে নিজেকে সম্পর্ণরূপে তাঁর দাসত্বের জন্য সঁপে দেওয়া। নিজের হজ আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য বা মাকবুল করানোর জন্য সব করণীয় সম্পর্কে অবগত হওয়া। কারণ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আর মাবরুর হজের প্রতিদান জান্নাত ভিন্ন অন্য কিছু নয়। (বুখারি, হাদিস : ৩৭৭১)। তাই মাবরুর বা মকবুল হজের জন্য নিম্নের বিষয়গুলোর প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত।
বৈধ উপার্জন দিয়ে হজের খরচ সংগ্রহ : আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, অবৈধ উপার্জন নিয়ে কোনো ব্যক্তি যখন হজের উদ্দেশ্যে বের হয় এবং বাহনের পা-দানিতে পা রেখে ঘোষণা দেয় : ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’, তখন আসমান থেকে একজন ঘোষক তার ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘তোমার জন্য কোনো লাব্বাইক নেই, তোমার জন্য কোনো সৌভাগ্যবার্তা নেই। তোমার পাথেয় হারাম। তোমার ব্যয়-খরচ হারাম। তোমার হজ কবুল করা হয়নি।’ (মুআত্তা ইমাম মালেক, ১/৩০৭)
সুনাম কুড়ানোর মানসিকতা বর্জন : হজ একদিকে যেমন সারা জীবনের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন, তেমনি তাতে মানুষের মধ্যে নিজের হজের প্রচারের মানসিকতাও অনেক বেশি দেখা যায়। তাই এ ক্ষেত্রে খুব সতর্কতা কাম্য। আনাস ইবন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হে আল্লাহ, এমন হজের তাওফিক দান করুন, যা হবে লোক-দেখানো ও সুনাম কুড়ানোর মানসিকতা মুক্ত। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৮৯০)
খাঁটি মনে তাওবা করা : রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যে হজ করেছে, অতঃপর কোনো পাপ কাজে লিপ্ত হয়নি, সে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে বাড়িতে ফেরে। এই যে গুনাহ মাফের মহা আয়োজন এর সর্বান্তঃকরণ প্রাপ্তি নিশ্চিত হতে একাগ্রচিত্তে তাওবা করা অত্যাবশ্যক।
আহার করানো ও ভালো কথা বলা : জাবের ইবন আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, কোন কাজ হজকে মাবরুর করে? তিনি বলেন, ‘আহার করানো এবং ভালো ও সুন্দর কথা বলা।’ (মুস্তাদরাক : ১/১৭৭৮)
বেশি বেশি দোয়া করা ও সালাম বিনিময় করা : হজ একটি কষ্টসাধ্য ইবাদত। এটির যথার্থ বাস্তবায়নে মহান আল্লাহর কাছে বেশি করে দোয়া করা উচিত। আত্মীয়-প্রতিবেশীর কাছে দোয়া চাওয়া উচিত। বিশেষ করে মা-বাবা বেঁচে থাকলে তাঁদের আন্তরিক দোয়া নিয়ে হজের প্রস্তুতি শুরু করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ রাসুল (সা.) বলেছেন, তিনটি দোয়া এমন রয়েছে যেগুলো কবুল হওয়া নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এক. মজলুমের দোয়া, দুই. মুসাফিরের দোয়া, তিন. সন্তানের জন্য মা-বাবার দোয়া। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৮৬২)
জাবের ইবন আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, কোন কাজের দ্বারা হজ মাবরুর হয়? তিনি বলেন, খাবার খাওয়ানো এবং বেশি বেশি সালাম বিনিময়ের দ্বারা। (মুসনাদে আহমদ : ৩/৩২৫)
তালবিয়া পাঠ ও কোরবানি করা : আবু বকর (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, হজ অবস্থায় কোন কাজে সওয়াব বেশি? তিনি বলেন, উচ্চৈঃস্বরে তালবিয়া পড়া এবং জন্তুর রক্ত প্রবাহিত করা। (তিরমিজি, হাদিস : ২৯৯৮)
সফরসঙ্গীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করা : আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা.) বলেন, ‘হজের মধ্যে সবচেয়ে পুণ্যময় কাজ খাবার খাওয়ানো এবং সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করা।’ (আল-ইসতিযকার : ৪/১০৪)
অধিক পরিমাণে ক্ষমা চাওয়া : কোনো আমল পূর্ণাঙ্গরূপে আদায়ের যতই চেষ্টা করা হোক, কোথাও না কোথাও ত্রুটি থেকে যাওয়া স্বাভাবিক। এ ধরনের ত্রুটি থেকে আমলকে পরিচ্ছন্ন করার জন্য ইবাদতের পর ইস্তিগফার (কৃত অন্যায় থেকে ক্ষমা প্রার্থনা) করার নির্দেশ রয়েছে। হজের কর্মধারা উল্লেখপূর্বক ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর তোমরা তাওয়াফের জন্য দ্রুতগতিতে সেখান থেকে ফিরে আসো, যেখান থেকে সবাই ফেরে। আর আল্লাহর কাছে মাগফিরাত কামনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাকারী, করুণাময়।’ (সুরা : মুমিন, আয়াত : ৬০)
মোটকথা মাবরুর হজ তো সেটিই, যাতে কল্যাণের পূর্ণ সমাহার ঘটে। যাতে পূর্ণমাত্রায় হজের সব রুকন, ওয়াজিব ও সুন্নত আদায় করা হয়। সেই সঙ্গে তাতে সব ধরনের গুনাহ ও পাপাচার থেকে বিরত থাকা হয়। হজ পালন করা আল্লাহ প্রদত্ত এক বিশেষ অনুগ্রহ। যাদের সৌভাগ্যে হজের সুযোগ ঘটে তাদের উচিত মাবরুর হজ পালনের সর্বময় চেষ্টা করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে বাইতুল্লাহর প্রকৃত মেহমান হওয়ার তাওফিক দান করুন।