দিনভর বৃষ্টিতে ডুবল ঢাকা, ভোগান্তিতে রাজধানীবাসী

প্রকাশকালঃ ১৩ জুলাই ২০২৪ ১২:৩৬ অপরাহ্ণ ৪৯৭ বার পঠিত
দিনভর বৃষ্টিতে ডুবল ঢাকা, ভোগান্তিতে রাজধানীবাসী

বৃষ্টির পানিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার ভোগান্তি থেকে কিছুতেই মুক্তি মিলছে না রাজধানীবাসীর। এ থেকে মুক্তি পেতে দায়িত্বশীলরা মহাপরিকল্পনার পর মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করলেও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, ময়লা ফেলায় নগরবাসীর অসচেতনতার কারণে অল্প সময়ে ভারি বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতায় নাকাল হচ্ছে রাজধানীবাসী। গতকাল শুক্রবার ছুটির দিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টার টানা বৃষ্টিতে অপ্রত্যাশিত ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে রাজধানীবাসীকে।


দেখা গেছে, গতকাল সকালে যারা বাসা থেকে বের হয়েছে, বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়েই তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়েছে। অনেকে সঙ্গে ছাতা বহন করলেও প্রবল বর্ষণে তা কাজে লাগেনি। ফলে পথচারীসহ ছিন্নমূল মানুষদের অনেককে আশ্রয় নিতে হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনার নিচে। এ সময় রিকশাসহ গণপরিবহন চলাচলও ছিল কম।


ফলে দিনভর ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে সাধারণ মানুষের। টানা ছয় ঘণ্টার ভারি বৃষ্টিতে সড়কের জলাবদ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, চাকরির পরীক্ষাকেন্দ্র, নিউ মার্কেট, কৃষি মার্কেটসহ অনেক এলাকার বাসাবাড়ির নিচতলায়। রাজধানীতে গতকাল সকাল ৬টা থেকে শুরু হয় ঝুমবৃষ্টি। থেমে থেমে এই বৃষ্টি অব্যাহত ছিল বিকেল পর্যন্ত।


কারওয়ান বাজার, শাহজাহানপুর, মালিবাগ রেলগেট, মৌচাক, মগবাজার, পশ্চিম তেজতুরী বাজার, তেজকুনীপাড়া, ধানমণ্ডি, ভাটারা, বাড্ডা, পশ্চিম শেওড়াপাড়ার বর্ডারবাজার, দক্ষিণ মনিপুরের মোল্লাপাড়া, পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর অনেক এলাকার রাস্তায় জমে যায় পানি। কোথাও হাঁটুপানি আবার কোথাও কোমর সমান পানি জমে পথচারীদের চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি করে।

 

বাসাবাড়ির নিচতলায় জমেছে পানি

সবুজবাগ ও খিলগাঁও থানাধীন রাজধানীর পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকা হওয়ায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত এ অঞ্চলের বেশির ভাগ মহল্লার অলিগলি ছিল পানির নিচে। বিকেল ৪টায় সবুজবাগ থানার বাসাবো, নন্দীপাড়া ও গোড়ানের বেশির ভাগ রাস্তায় ছিল হাঁটু সমান পানি। খিলগাঁও থানার ভূঁইয়াপাড়া, তিতাস রোড, বনশ্রীর বেশির ভাগ সড়ক সন্ধ্যা পর্যন্ত হাঁটুপানিতে নিমজ্জিত ছিল। জলাবদ্ধতায় এসব এলাকায় দেখা দেয় দুর্ভোগ। সড়ক পানিতে নিমজ্জিত থাকায় এসব এলাকার বাসিন্দারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। জলাবদ্ধতার কারণে সড়কে রিকশাসহ অন্য যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। তিতাস রোডে একটি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার সাইফ উদ্দিন বলেন, ‘শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হলেও আমরা পণ্য ডেলিভারি দিয়ে থাকি। কিন্তু পানি ওঠায় আজ ডেলিভারি দেওয়া সম্ভব হয়নি। পানি অপসারণে কেউ এখন পর্যন্ত কোনো কিছু করেনি।’

 

বৃষ্টিতে বিপাকে চাকরির পরীক্ষার্থীরা

সাপ্তাহিক ছুটির দিন গতকাল সকালের ঝুমবৃষ্টিতে বিপাকে পড়েন ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়া চাকরিপ্রার্থীরা। সকাল ৯টা থেকে পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বৃষ্টির কারণে অনেকে বাসা থেকে বের হতে পারেননি। অনেকে বের হলেও সড়কে পর্যাপ্ত যানবাহন না থাকায় বিপাকে পড়েন। এই সুযোগে সিএনজি-রিকশাচালকরা ভাড়া দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেন। বাধ্য হয়ে বেশি ভাড়ায় গন্তব্যে যেতে হয়েছে যাত্রীদের। ঢাকার ধামরাই থেকে মিরপুর বাঙলা কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে আসেন আল-আমিন। সঙ্গে ছাতা না থাকায় টেকনিক্যাল মোড় থেকে বাঙলা কলেজ গেট পর্যন্ত যেতে রিকশাচালক তাঁর কাছে ৫০ টাকা ভাড়া চেয়েছেন। বাধ্য হয়ে ওই টাকা দিয়েই তিনি কেন্দ্র পর্যন্ত গেছেন বলে জানান।

 

ভারি বৃষ্টিতে ডুবল ঢাকা মেডিক্যাল

গতকাল সকাল থেকে ভারি বৃষ্টির কারণে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ চত্বরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই পায়নি হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পও। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে প্রায় হাঁটু সমান পানি জমে যায়। এতে হাসপাতালে সেবা নিতে আসা লোকজনকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। এ ছাড়া জরুরি বিভাগে প্রবেশের সময় ডান দিকে হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পে সড়ক থেকে উপচে পড়ে বৃষ্টির পানি প্রবেশ করে। এতে ক্যাম্পের ফ্লোর পুরোটাই তলিয়ে যায়। পুরনো ভবনের নিচতলায় ভ্যাকসিন সেন্টার বেইসমেন্টেও পানি প্রবেশ করে। সেখানে এক পর্যায়ে বালুর বস্তা ফেলে পানি আটকানো হয়েছে।

 

ঢাবির দুই হলে হাঁটুপানি, শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে গতকাল ভারি বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন শিক্ষার্থীরা। দুপুরে হলের আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দুই হলের গেট থেকে শুরু করে পেছন পর্যন্ত কোথাও হাঁটুপানি আবার কোথাও কোমর সমান পানি জমে আছে। হল দুটিতে ছিল না বিদ্যুৎ, বন্ধ হয়ে যায় ক্যান্টিনসহ অন্যান্য ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েন এই দুই হলের নারী শিক্ষার্থীরা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল, ফজলুল হক হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, শাহনেওয়াজ হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলসহ প্রায় সব হলের একই অবস্থা ছিল।

 

নিউ মার্কেটে কোমরপানি, বিপাকে ব্যবসায়ীরা

গতকাল সকালের বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকা। কোমর সমান পানি পার হয়ে রাস্তায় চলাচল করতে হয়েছে অনেককে৷ সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েন ব্যবসায়ীরা। দুপুরে নিউ মার্কেট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, একেবারেই প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাসা থেকে বের হচ্ছে না। যারা বের হয়েছে, সামান্য পথ যেতে রিকশা বা ভ্যানে উঠতে হয়েছে তাদের। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা৷ নিচতলায় থাকা বেশির ভাগ দোকানে পানি প্রবেশ করায় মালপত্র সরিয়ে নিতে হয়েছে অনেককে।

 

কৃষি মার্কেটে পানি, ডুবেছে চাল-ডাল-চিনি

বৃষ্টিতে মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটে পানি উঠেছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার জলাবদ্ধতার সঙ্গে এই মার্কেটেও ঢুকেছে পানি। এতে সারি করে রাখা চাল, চিনি আর ডালের বস্তা পানিতে ডুবে যায়। মার্কেটটি রাস্তা থেকে খানিকটা নিচু। ফলে পানি প্রবেশ ঠেকাতে গলির মুখগুলো উঁচু করা হয়েছে। কিন্তু গতকালের টানা বৃষ্টি এসবের কিছুই মানেনি। দুপুরে দেখা যায়, বালতি আর ড্রাম নিয়ে মার্কেটের পানি বের করছেন ব্যবসায়ীরা।

 

পানি আটকাতে গলির মুখে পেপার ও বস্তা দিয়ে আরো উঁচু করে দিয়েছেন। বিক্রি বন্ধ রেখে চাল-ডালের বস্তা বাঁচাতে ব্যস্ত ব্যবসায়ীরা। কৃষি মার্কেটের চালের আড়তের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম মন্টু গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এই মার্কেটে পাইকারি পণ্যের দোকান আছে দুই শর মতো। এর মধ্যে শতাধিক দোকানের চাল, ডাল, চিনি কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’

 

সড়কে গণপরিবহন সংকট

সড়কে জলাবদ্ধতার কারণে পুরান ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে ভোগান্তিতে পড়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা। সড়কে পানির কারণে হিউম্যান হলারের (লেগুনা) মতো যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মূল সড়কে রিকশা যেতে চায়নি। লালবাগ ও চকবাজারের বাসিন্দাদের গুলিস্তানে যেতে হলে লেগুনার বিকল্প নেই। সরেজমিনে লালবাগের সেকশনে গিয়ে দেখা যায়, ২০ টাকার লেগুনাভাড়া যাত্রীদের কাছে ৫০ টাকা চাওয়া হচ্ছে।

 

তা-ও গুলিস্তান পর্যন্ত যাওয়া যাবে কি না চালক সেই নিশ্চয়তা দেননি। পানিতে গাড়ি কোথাও বন্ধ হয়ে গেলে যাত্রীদের সেখানে নেমে যেতে হবে, সে কথা আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়। গুলিস্তান যাওয়ার অপেক্ষায় আজিমপুর স্টেশনে ঘোরাঘুরি করছিলেন নোমান আহাম্মেদ। কথা হলে তিনি বলেন, এখানে হাজারীবাগ, চকবাজার, লালবাগের লেগুনা পাওয়া যায়। কিন্তু ৪০ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে একটা লেগুনারও দেখা পেলাম না।

 

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘কম সময়ে ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টি হওয়ায় পানি সরাতে আমাদের বেগ পেতে হচ্ছে। আমাদের তিনটি পাম্প চলছে, যেগুলো সেকেন্ডে প্রায় ১০ হাজার লিটার পানি সরাতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, পাম্প টানা চালানো যাচ্ছে না। একটু পর পর ময়লায় পাইপে জ্যাম সৃষ্টি হচ্ছে।’

 

তিনি আরো বলেন, ‘পানি সরাতে যে কত প্রতিবন্ধকতা, তা গণমাধ্যমকর্মীরা এসে  দেখে যেতে পারেন। পলিথিন বর্জ্য থেকে মানুষের বাড়ির ছোট-বড় এমন কোনো ময়লা-আবর্জনা নেই, যা পানির স্রোতের সঙ্গে এখানে আসছে না। ড্রেনের মুখগুলো সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। খালগুলো দখল করায় সংকুচিত হয়ে এখন ড্রেনের পর্যায়েও নেই। পাম্প টানা চালানো না গেলে কিভাবে পানি দ্রুত সরবে। তবে আর বৃষ্টি না হলে পাঁচ-ছয় ঘণ্টার (সন্ধ্যা ৭টায় বলেছেন) মধ্যে পানি সরে যাবে।’

 

ডিএসসিসির প্রকৌশলীরা বলছেন, কাজী আলাউদ্দীন সড়ক, আগা সাদেক সড়কসহ আশপাশের এলাকার সড়কের পানি সরাতে নতুন করে আরেকটি সংযোগ লাইন তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ওই সংযোগ লাইনের কাজ শেষ হলে এসব এলাকার পানি সহজে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়বে। এতে পুরান ঢাকার বাসিন্দারা জলাবদ্ধতার ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবে।

 

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্ষা শুরুর আগেই ডিএনসিসির বিভিন্ন ওয়ার্ডে ড্রেন পরিষ্কার করা হয়েছে। এর পরও অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে কিছু এলাকায় পানি জমেছে। তবে ডিএনসিসির পাঁচ হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং ১০টি রেসপন্স টিম দ্রুত ওই সব এলাকা থেকে পানি সরিয়ে নেওয়ার কাজ করছে।’

 

পানি সরাতে ডিএনসিসির পাঁচ হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মী

গতকাল ভোর থেকে ভারি বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পাঁচ হাজারের বেশি পরিচ্ছন্নতাকর্মী। এ ছাড়া ১০টি অঞ্চলে কাজ করছে ১০টি কুইক রেসপন্স টিম (ছজঞ)। গতকাল বিকেল পর্যন্ত প্রধান সড়কগুলো থেকে পানি নিষ্কাশন করা হয়।

 

জলবদ্ধতা নিরসনে মাঠে ছিল ডিএসসিসি

জলাবদ্ধতা নিরসনে গতকাল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও প্রকৌশল বিভাগের ১০০টি টিম মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছে।