সেরা ডাক্তাররা — আয়-সম্পদের তুলনায় বড় অংকের কর ফাঁকি

  প্রিন্ট করুন   প্রকাশকালঃ ০২ নভেম্বর ২০২৫ ০৩:৪৩ অপরাহ্ণ   |   ৩৯ বার পঠিত
সেরা ডাক্তাররা — আয়-সম্পদের তুলনায় বড় অংকের কর ফাঁকি

দেশে ১৭ কোটির বেশি মানুষের সেবা দেয়ার জন্য প্রায় দেড় লাখ ডাক্তার রয়েছেন। কিন্তু হাসপাতাল-চেম্বারে রোগীর দীর্ঘ লাইন, উচ্চ ফি ও নানা পরীক্ষার অতিরিক্ত খরচ—সব মিলিয়ে স্বাস্থ্যখাতে প্রচুর অর্থ চলে যায়। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, ডাক্তাররা যে আয় করেন তার বড় একটি অংশই করদায়ের বাইরে রেখে দেন। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধান ও সরকারি তথ্য-উপাত্ত এ অনিয়মের সর্পিল চিত্র দাঁড় করিয়েছে।

 


 

শুধু দুর্বল বোধ বা অসচেতনতার কারণে নয় — অনেক ক্ষেত্রে আয়-সম্পদ জাহির না করে, নগদ লেনদেন বাড়িয়ে এবং কমিশন-উপহার লাভ করে ডাক্তারেরা বড় অংকের কর ফাঁকি দিচ্ছেন। কর বিভাগের কাছে ধরা পড়লে অনেকে জরিমানা ও পরবর্তী ট্যাক্স পরিশোধ করছেন; কিন্তু তবু অধিকাংশই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশে অন্তত ১০ হাজার এমন ডাক্তার আছেন যারা বছরে গড়ে প্রচুর কর ফাঁকি দিচ্ছেন; কালের কণ্ঠের হিসেব অনুযায়ী এই পরিমাণ বছরে কমপক্ষে ৬ হাজার ২৫০ কোটি টাকা
 

অনুসন্ধানে উঠে এলো দুই শীর্ষচিকিৎসকের কাহিনি

রাজধানীতে এক মাসের বেশি সময়ে বিশেষ করে দুই শীর্ষ স্তরের চিকিৎসকের আয়ের সঙ্গে তাঁদের আয়কর রিটার্নের অমিল নিয়েই অনুসন্ধান চালানো হয়েছে।
 

প্রফেসর ডা. কাজী দ্বীন মোহাম্মদ — নিউরো মেডিসিনে পরিচিত একটি নাম। কর অঞ্চল-২৩-এ রিটার্নে তাঁর দেখানো আয় ছিল ২০২৩–২৪ করবর্ষে ৭,৪৮,০০০ টাকা ও সম্পদ ৫,৬৯০,০০০ টাকা; ২০২৪–২৫ করবর্ষে ৭,৫৫,৭৩০ টাকা আয় ও ৬,২৮৭,০০০ টাকা সম্পদ।
তাহলে বাস্তবে কী হচ্ছিল? অফিস টাইমে তাঁর চেম্বারে সিরিয়াল পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার—রোগী দেখা শুরু করেন বিকেল ৪টা থেকে এবং প্রয়োজনে রাত ১টা পর্যন্ত রোগী দেখেন। দিনে গড় কমপক্ষে ৫০ জন রোগী; প্রতিটি রোগীর ফি দাঁড়ায় ১,৫০০ টাকা—এ হিসেবে দৈনিক ফি আয় ৭৫,০০০ টাকা। মাসে ২২ দিন কাজ করলে মাসিক ফি আয় হয় ১৬,৫০,০০০ টাকা; বছরের ২০০ দিন রোগী দেখলে বছরে রোগী ফি থেকেই আয় দাঁড়ায় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। сюда শরীরভরা ভর্তি, সার্জারি, টেস্ট কমিশন ও ওষুধ কোম্পানির সুবিধা যোগ করলে মোট আয় সহজেই দ্বিগুণ হয়ে যাবে—অর্থাৎ বছরে অন্তত ৩ কোটি টাকার মতো আয় পাওয়া সম্ভব, যা রিটার্নে প্রদর্শিত হয়নি বলে অনুসন্ধান প্রকাশ করে।

 

প্রফেসর ডা. এ কে এম মূসা — বারডেমের মেডিসিন বিভাগের প্রধান। কর অঞ্চল-১০-এ তাঁর রিটার্নে ২০২৩–২৪ করবর্ষে আয় দেখানো আছে ৩২,৩৫,৪৪৬ টাকা ও সম্পদ ৪,১২০,০০০ টাকা; ২০২৪–২৫ করবর্ষে আয় ৪৬,০৪,৪৭০ টাকা ও সম্পদ ৪,৪১০,০০০ টাকা। তবে সরেজমিন দেখে পাওয়া যায়: আলোক হেলথকেয়ার ও ল্যাবএইডে তাঁর চেম্বারে ভোরে সিরিয়াল নিতে ভোর ৬:৩০ পর্যন্ত উপস্থিত থাকতে হয়; তিনি সপ্তাহে সাত দিন (আলোকে বৃহস্পতিবার ছাড়া) সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রোগী দেখেন—গড়ে ৩৫ জন। এক হাসপাতালের গড় ফি ধরা হলে দৈনিক আয় ও ভাগাভাগির হিসেব মিলিয়ে বছরভিত্তিক রোগী ফি আয় প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ পর্যন্ত সহজে পৌঁছায়। তার ওপর বিভিন্ন টেস্ট-কমিশন ও ওষুধ কোম্পানির সুবিধা যোগ করলে প্রকৃত আয় আরো অনেক বেশি হতে পারে। রিটার্নে দেখানো সংখ্যার সঙ্গে এটি মিলছে না—শুধু রোগী ফি বাবদই রিটার্নে দেখানো আয়ের তুলনায় তাঁর আয় কম দেখানো হয়েছে অন্তত ৮৩ লাখ ১০ হাজার ৫৩০ টাকা; টেস্ট ও ওষুধের কমিশন যোগ করলে তা দুই কোটি টাকারও বেশি হতে পারে।
 

বিস্তৃত চিত্র: কর ফাঁকি ও রাজস্ব ক্ষতি

আয়কর নির্দেশিকা অনুযায়ী ডাক্তারদের বার্ষিক যাবতীয় আয়ের তথ্য (চেম্বার ফি, বেতন, ভাতা, অন্যান্য আয়) রিটার্নে দিতে বাধ্য। তা সত্ত্বেও উপরে উদাহৃত দুই চিকিৎসকসহ অনেকেই ন্যূনতম বা নামমাত্র আয় দেখান। কালের কণ্ঠের বিশ্লেষণ—যদি শুধু চলতি শীর্ষ চিকিৎসকদের মতো গড়ে প্রতি ডাক্তার ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা কর ফাঁকি করে—তাহলে ১০ হাজারটি সেইরকম কেস মিললে বাৎসরিক অঙ্ক দাঁড়ায় ৬ হাজার ২৫০ কোটি টাকা; পাঁচ বছরে তা হয়ে ওঠে ৩১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। এসব টাকা দিয়ে পরিকল্পিতভাবে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প করা যেত—উদাহরণস্বরূপ দেশের একমাত্র মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৩,৪৭২ কোটি টাকা।
 

কর ফাঁকির দায়ে শাস্তি ও তদন্তের আইনগত ব্যাখ্যা দিয়েছে আয়কর আইন ২০২৩: আয় গোপন বা মিথ্য তথ্য দিলে ইচ্ছাকৃত করপলায়নের ক্ষেত্রে শাস্তি হতে পারে — সর্বনিম্ন ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।
 

কর্তৃপক্ষ কী করছে?

আয়কর বিভাগ জানিয়েছে—রাজস্ব কমিশনারদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে; গোয়েন্দা কার্যক্রম বেগবান করতে প্রতিটি কর অঞ্চলে গোয়েন্দা ও তদন্ত সেল (আইআইসি) স্থাপন করা হয়েছে; যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তাঁদের ফাইল নিয়ে কাজ করা হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, অনেক রকম আয় নগদে হয়, ব্যাংক লেনদেনে ধরা পড়ে না, ফলে অডিট বা তদন্তেও সীমাবদ্ধতা থাকে। নেতিবাচক উদাহরণও রয়েছে: পদ্মা-মেট্রোর মতো বড় প্রকল্পগুলোর আর্থিক প্রয়োজনীয়তা পূরণে রাজস্ব ক্ষতি গুরুতর প্রভাব ফেলছে—এই ঘাটতি মোকাবেলায় কর ব্যবস্থায় কড়াকড়ি ও কার্যকর নজরদারি জরুরি।
 

সিপিডি-এর একজন গবেষক বলেছেন—করদানের দায়িত্ব শুধু ‘শীর্ষ পেশা’ নয়, সব স্তরের মানুষের; যারা নিয়ম ব্যহত করে কর ফাঁকি দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় আইনগত নজির স্থাপন হলে অন্যরাও সাবধান হতেন।