প্রকাশকালঃ
২২ জুন ২০২৩ ১১:০৯ পূর্বাহ্ণ ১৭৮ বার পঠিত
কোরবানি শব্দের অর্থ নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম। আরবি ভাষায় এটি ‘উজহিয়্যাহ’ নামে পরিচিত। শাব্দিক অর্থে কোরবানি বলা হয়, যে পশু জবাই করা হয়। ইসলামের পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের জন্য কোরবানির দিন বা পরের তিন দিনের কোনো এক দিন পশু জবাই করাকে ‘উজহিয়্যাহ’ বা কোরবানি বলা হয়। (মুজামু মাকায়িসুল লুগাহ, পৃষ্ঠা : ৩৯১/৩)
কোরবানির তাৎপর্য : মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা করা ও নিজের প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করার দৃষ্টান্ত থেকে পশু কোরবানির সূচনা হয়। শেষনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের আগে যুগে যুগে সব শরিয়তে কোরবানির বিধান চালু ছিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি সব জাতির জন্য কোরবানির বিধান রেখেছি, যেন আমি তাদের জীবনোকরণ হিসেবে যে চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি তাতে (জবাই করার সময়) আল্লাহর নাম স্মরণ করে। (সুরা হজ, আয়াত : ৩২)
সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর শর্তসাপেক্ষে কোরবানি করা ওয়াজিব। ১০ থেকে ১৩ জিলহজের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী হলে কোরবানি করা ওয়াজিব। অর্থাৎ এই সময় কারো কাছে সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে ৫২ ভরি রুপা থাকলে অথবা এর মূল্যের সমপরিমাণ সম্পদ প্রয়োজনের অতিরিক্ত থাকলে কোরবানি করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি তোমার রবের জন্য নামাজ আদায় করো এবং কোরবানি করো।’ (সুরা : কাউসার, আয়াত : ২)।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকার পরও কোরবানি করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২১২৩)
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি : মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে কোরবানি করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লহর কাছে (কোরবানির পশুর) মাংস, রক্ত পৌঁছে না, বরং আল্লাহর কাছে তোমাদের তাকওয়াত (তথা একনিষ্ঠভাবে সম্পন্ন আমল) পৌঁছে।’ (সুরা হজ, আয়াত : ৩৭)
কোরবানির সওয়াব : জায়েদ বিন আরকাম (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.)-এর সাহাবিরা জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), এই কোরবানি কী? তিনি বলেন, এটা তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত। ফের তাঁরা জিজ্ঞেস করল, এতে কি আমাদের সওয়াব আছে? তিনি বললেন, এর প্রত্যেক পশমের বিনিময়ে একটি সওয়াব হবে।
তারা বলল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), ভেড়ার পশমের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য? তিনি বললেন, ভেড়ার প্রত্যেক পশমের বিনিময়ে একটি সওয়াব লেখা হবে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং : ২৬০)
প্রথম যিনি কোরবানি করেছেন : সর্বপ্রথম আদম (আ.)-এর দুই সন্তান হাবিল ও কাবিল কোরবানি শুরু করেছেন। পবিত্র কোরআনে তাদের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তারা একটি বিরোধ মীমাংসার জন্য কোরবানি করেন। আল্লাহ বলেছেন, ‘আদম (আ.)-এর দুই পুত্রের ঘটনা তাদের যথাযথভাবে শোনান, যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল করা হয় এবং অন্যজনের কবুল হয়নি।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ২৭)
দুই ভাইয়ের মধ্যে হাবিলের কোরবানি কবুল হয়। যার কোরবানি কবুল হয়নি সে অন্যজনকে হত্যার হুমকি দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি আমাকে হত্যার জন্য হাত বাড়ালেও আমি তোমাকে হত্যার জন্য হাত বাড়াব না, আমি উভয় জগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি। আমি চাই তুমি আমার ও তোমার পাপের ভার বহন করো এবং জাহান্নামের অধিবাসী হও, এটা অত্যাচারীদের কর্মফল। অতঃপর তার ভাইকে হত্যা করতে উত্তেজিত হয়, অতঃপর সে তাকে হত্যা করে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ২৮)
ভাইয়ের মরদেহ দাফনের শিক্ষা : ভাইকে হত্যার পর তাঁর মরদেহ নিয়ে অপর ভাই দুশিন্তায় পড়েন। এমন সময় আল্লাহ একটি কাক পাঠিয়ে মরদেহ দাফনের শিক্ষা দেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর আল্লাহ একটি কাক পাঠান, যে তার ভাইয়ের মৃতদেহ কিভাবে গোপন করতে হয় তা দেখানোর জন্য মাটি খনন শুরু করে, ওই ভাই বলল, হায় আমি কি এই কাকের মতোও হতে পারলাম না, যাতে আমি নিজের ভাইয়ের মৃতদেহ গোপন করতে পারি! অতঃপর সে অনুতপ্ত হলো।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৩১)
ইবরাহিম (আ.)-এর প্রিয় বস্তু কোরবানি : মূলত আল্লাহর নবী ইবরাহিম (আ.)-এর অনুসরণ করে মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতের জন্য প্রচলিত পদ্ধতিতে কোরবানির নিয়ম বিধিবদ্ধ হয়। মহান আল্লাহ ইবরাহিম (আ.)-কে স্বপ্নযোগে তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে আল্লাহর জন্য কোরবানির নির্দেশ দেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তিনি সন্তানকে কোরবানি করতে পুরোপুরি প্রস্তুতি নেন। এমন সময় মহান আল্লাহ ইসমাঈল (আ.)-এর বদলে পশু কোরবানির নির্দেশ দেন। মুমিনরাও যেন নিজেদের প্রাণ ও প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর জন্য সঁপে দিতে সদা প্রস্তুত থাকে এটাই কোরবানির প্রধান শিক্ষা।
কোরআনে পিতা-পুত্রের আত্মত্যাগের ঘটনা : আল্লাহর জন্য পিতা ও পুত্রের উৎসর্গের পুরো ঘটনার বর্ণনা পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি [ইবরাহিম (আ.)] বলেন, হে আমার রব, আমাকে একজন সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান করুন। অতঃপর আমি তাকে একজন বুদ্ধিমান পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর সে [ইসমাঈল (আ.)] যখন কাজের বয়সে উপনীত হয়, তখন ইবরাহিম বলল, হে আমার পুত্র, আমি স্বপ্নে দেখি যে তোমাকে আমি জবাই করছি। এখন তোমার মত কী, বলো। সে বলল, হে আমার পিতা, আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন, আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং তিনি [ইবরাহিম (আ.)] পুত্রকে জবাইয়ের জন্য কাত করেন। তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহিম, আপনি স্বপ্নের আদেশ পালন করেছেন। আমি এইভাবেই সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই তা ছিল সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে একটি (কোরবানির) জন্তুর মাধ্যমে মুক্ত করি। আমি তা পরবর্তীদের জন্য বিধান হিসেবে রেখেছি।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত : ১০০-১০৮)