প্রকাশকালঃ
০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:২০ অপরাহ্ণ ২৫৫ বার পঠিত
সরকারি ব্যয় কমানো ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর পাশাপাশি সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করার ফলেই দ্রুত ঘুরতে শুরু করেছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির চাকা।
দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। দেশটির বিদেশি মুদ্রা আয়ের মূল খাত পর্যটন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। সেই সঙ্গে দেশটির সরকার ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানো ও সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। সব মিলিয়ে ২০২২ সালের এই সময়ে দেশটির যে অবস্থা ছিল, পরিস্থিতি এখন তার চেয়ে অনেক ভালো বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
গত বছর চরম বিপর্যয়ের মুখে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ৭ দশমিক ৮ শতাংশ সংকুচিত হয়। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অবশ্য বলছে, এ বছরও দেশটির জিডিপি সংকুচিত হবে, তবে সংকোচনের হার কমে আসবে। আর আগামী বছর প্রবৃদ্ধি হবে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঠিক পথেই আছে, প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো কাজ করছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের যেসব শর্ত পরিপালনের কথা বলে তারা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ পেয়েছে, সেসব শর্তও তারা অন্যান্য সমগোত্রীয় দেশের তুলনায় ভালোভাবে পরিপালন করতে পারছে।
এক বছর আগে অর্থনৈতিক সংকটে রীতিমতো অচল হয়ে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা—প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশ ছুঁয়ে যায়, জ্বালানিসংকট চরমে পৌঁছায়, আর পেট্রলপাম্পগুলোতে অপেক্ষমাণ যানবাহনের সারি কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।
অনেকেই এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার তুলনা করেন। ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক সম্পাদকীয়তে সম্প্রতি বলা হয়েছে, পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের চেয়ে শ্রীলঙ্কা অনেক ভালো করছে। সেখানে বলা হয়েছে, দুই দেশের মধ্যকার মূল পার্থক্য হলো, শ্রীলঙ্কার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো পাকিস্তানের চেয়ে অনেক শক্তিশালী।
এক বছর আগে অর্থনৈতিক সংকটে রীতিমতো অচল হয়ে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা—প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশ ছুঁয়ে যায়, জ্বালানিসংকট চরমে পৌঁছায়, আর পেট্রলপাম্পগুলোতে অপেক্ষমাণ যানবাহনের সারি কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। জন–অসন্তোষ চরমে ওঠে। গণরোষের মুখে পড়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। এরপর দায়িত্ব নেন রানিল বিক্রমাসিংহে।
গত বছরের সেই দৃশ্য আর চোখে পড়ে না। রানিল বিক্রমাসিংহে এখন পর্যন্ত দেশকে ঠিক পথেই নিয়ে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
যেভাবে পরিবর্তনের পথে
বিবিসির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু নীতিগত পদক্ষেপের কারণে দেশটিতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। প্রবাসী আয় ও পর্যটনের মতো কিছু খাত একরকম ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ফলে উন্নতি ঘটেছে সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির।
আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, শ্রীলঙ্কা সরকার ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব বাড়িয়েছে আর সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করে করজাল বিস্তৃত করেছে—মূলত এই দুটি নীতি পদক্ষেপের কারণে ঘুরতে শুরু করেছে দেশটির অর্থনীতির চাকা। তবে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, দেশটিকে এখনো লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে।
এ বিষয়ে শ্রীলঙ্কার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাক্রোইকোন রিস্ক অ্যান্ড ফ্রন্টিয়ার রিসার্চের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ঝুঁকি বিভাগের প্রধান ছায়ু দামাসিংহে বলেন, গত বছর জ্বালানি ও রান্নার তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যে স্বল্পতা ছিল, সেটা এখন নেই। মূল্যস্ফীতির হার অনেকটাই কমেছে। এই সবকিছুই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের অংশ। বাস্তবতা হলো, পরিস্থিতি গত বছর যতটা খারাপ ছিল, এ বছর ততটা নয়।
আরেকটি বিষয় হলো, যে কারণে গত বছর এ রকম সংকট হলো, সেটা আমলে নেওয়া। সংকটের মূল কারণ ছিল বাজেট ও বহিঃস্থ অর্থনীতির ঘাটতি, যে কারণে ঋণসংকট তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। ঋণসংকট মোকাবিলায় এই দুই প্রতিষ্ঠান ঋণ পুনর্গঠন করছে। এ ছাড়া সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে নতুন কর আইন করাসহ করহার বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং ব্যয় সংকোচন করা হচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কী করা হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে ছায়ু দামাসিংহে বলেন, মূল্যস্ফীতির একটি কারণ ছিল দেশ থেকে অর্থ বেরিয়ে যাওয়া। সেটা হতো মূলত আমদানির মাধ্যমে, যার মূল্য পরিশোধ করতে হতো ডলারে। ডলার বেরিয়ে গেলে স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় মূল্য কমে যায়, যে কারণে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে।
নতুন গভর্নর আসার পর সরকার তাঁকে স্বাধীনভাবে দুটি কাজ করার সুযোগ দেয়। মূলত যে দুটি খাতে তিনি হাত দেন তাহলো, নীতি সুদহার বৃদ্ধি ও মুদ্রার একক বিনিময় হার নিশ্চিত করা। অন্যান্য দেশের মতো শ্রীলঙ্কায়ও মুদ্রার অনানুষ্ঠানিক বাজার আছে, সেখানকার কারসাজির কারণেও মুদ্রার বিনিময় হারে প্রভাব পড়ে, মূল্যস্ফীতি বাড়ে। তবে মুদ্রার বিনিময় হারের ওঠানামা করলেও নীতি সুদহার বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা গেছে।
শ্রীলঙ্কার সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের জুলাই মাসে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। এ সময়ে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কমেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে সংকটের চূড়ান্ত সময়ে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪৯ শতাংশের বেশি।
আরেকটি খাতে শ্রীলঙ্কা গত এক বছরে অনেক ভালো করেছে। সেটা হলো শ্রমশক্তি রপ্তানি। বস্তুত গত বছর বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে দেশটি। ২০২২ সালে দেশটির ৩ লাখ ১১ হাজারের বেশি মানুষ কাজের জন্য বিদেশে গেছেন, যাঁদের মধ্যে চিকিৎসক, প্যারামেডিকেল, তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের মতো অনেক উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী আছেন। এঁরা বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় পাঠানোর কারণে গত এক বছরে দেশটির প্রবাসী আয় ৭৬ শতাংশ বেড়েছে।
আইএমএফের শর্ত পরিপালন
যখন কোনো দেশ ভুল নীতি, অব্যবস্থাপনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং অন্য বাজার যখন তাকে ঋণ দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে, তখনই তারা সাধারণত আইএমএফের দ্বারস্থ হয়। এসব ক্ষেত্রে আইএমএফ স্বল্প সুদে ও স্বল্প মেয়াদে ঋণ দেয়। আইএমএফ কোনো বিপদগ্রস্ত দেশকে ঋণ দিয়েছে—এটা জানলে সেই দেশ সম্পর্কে বাজারও আশ্বস্ত হয়। তখন অন্যরাও এগিয়ে আসে।
তবে আইএমএফের ঋণের সঙ্গে নানা ধরনের শর্ত থাকে। এসব শর্ত পূরণ করা সাপেক্ষেই ঋণ দেওয়া হয়। এতে অনেক দেশ উপকৃত হয়, আবার অনেক দেশ বিপদে পড়ে। তবে শ্রীলঙ্কা এবার আইএমএফের ঋণের বেশির ভাগ শর্ত ভালোভাবেই পূরণ করতে পেরেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
শ্রীলঙ্কার সানডে মর্নিং পত্রিকার এক সংবাদে বলা হয়েছে, আইএমএফের পরিমাণগত কর্মক্ষমতা মানদণ্ড (কিউপিসি) পূরণে দেশটি যথেষ্ট ভালো করেছে। এটা সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা হয়। এই মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হলে ঋণের পরবর্তী কিস্তি পেতে আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদ থেকে আবারও অনুমোদন নিতে হয়। তখন নির্বাহী পর্ষদ যদি মনে করে যে ঋণ কর্মসূচি চালিয়ে নেওয়া যাবে, তাহলে বাকি অর্থ ছাড়ের অনুমোদন দেওয়া হতে পারে।
আইএমএফের শর্ত মেনে শ্রীলঙ্কা ইতিমধ্যে রাজস্ব খাত সংহত করেছে। কর্তৃপক্ষ ভর্তুকি কমিয়ে এনেছে এবং করহার ও করের জাল বাড়িয়ে আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জনের দিকে বেশ এগিয়েছে। মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে এনেছে।
বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আগেও বলেছি, এখনো বলছি যে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের অবস্থা তুলনীয় নয়, তবে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। তারা যেভাবে বড় সমস্যা মোকাবিলা করে এখন স্থিতিশীল হচ্ছে, সেটাই শিক্ষণীয় বিষয়।’
এ ক্ষেত্রে কী শেখা যেতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে এখনো বিদেশি মুদ্রার সংকট আছে, যার প্রভাব অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও পড়েছে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ঝুঁকির মুখে পড়েছে সে কারণে। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও তাদের গভর্নর যেভাবে এই সংকট মোকাবিলায় নায়ক হিসেবে বেরিয়ে এসেছে, তা খুবই উল্লেখযোগ্য বিষয়।
তারা আগের নীতি থেকে সরে আসছে। কৃষি খাতে আগের ভুল নীতি থেকে সরে এসেছে। পর্যটন খাত চাঙা করা, প্রবাসী আয় বাড়ানো ও মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার মাধ্যমে তারা রিজার্ভ বাড়াচ্ছে। রাতারাতি কিছু হচ্ছে না, ধীরে ধীরে হচ্ছে, সেটাই নিয়ম। তবে তারা ঠিক পথেই আছে।
শ্রীলঙ্কার সব সংকট এখনো শেষ হয়নি। তাদের ঘাড়ে এখনো বড় অঙ্কের ঋণের বোঝা আছে। সেই ঋণ পরিশোধ করতে অর্থনীতির চাকা আরও সচল করতে হবে। সেটা করতে গেলে আবার অর্থনীতিতে অর্থের সঞ্চার করা প্রয়োজন।
তবে দেশটি এখন সবার আগে পূর্বের ভুল শোধরানোর চেষ্টা করছে। এই মুহূর্তে তাদের অগ্রাধিকার অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো। ফলে উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে খানিকটা সময় লাগবে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
এ বিষয়ে ছায়ু দামাসিংহে বলেন, শ্রীলঙ্কা ঠিক পথে আছে। তবে সবকিছু নির্ভর করবে নীতি ধারাবাহিকতার ওপর; এই সরকার ও পরবর্তী সরকার এসব পদক্ষেপের ধারাবাহিকতা কতটা রক্ষা করতে পারে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।