আরব লিগে প্রেসিডেন্ট আসাদের প্রত্যাবর্তন, কী বার্তা দেয়?
প্রকাশকালঃ
২১ মে ২০২৩ ০৩:২১ অপরাহ্ণ ১৬৭ বার পঠিত
এক দশকেরও বেশি সময় আগে সিরিয়ায় ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। একনায়ক বাশার আল-আসাদ এই যুদ্ধের শুরু থেকে ইসলামপন্থীসহ বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপ ও সুশীল সমাজকে ধ্বংস করতে ‘পোড়ামাটি নীতি’ গ্রহণ করেন। খবর বিবিসি ।
তার বিরুদ্ধে এর বিরোধিতায় অন্যান্য আরব দেশগুলো গোপনে সমর্থন যোগায় এবং এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট আসাদ আরব বিশ্বের সমাজচ্যুত নেতায় পরিণত হন।
বিরোধীদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের দায়ে আরব লিগ থেকে সিরিয়াকে বহিষ্কার করা হয় ২০১১ সালে। কিন্তু এখন এই দৃশ্যপট আমূল বদলে গেছে।
প্রেসিডেন্ট আসাদের প্রতিবেশী দেশগুলো তাকে পুনরায় বরণ করে নিচ্ছে। আরব দেশগুলোর জোট আরব লিগে প্রত্যাবর্তন ঘটেছে সিরিয়ার। এই ঘটনাকে দেখা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট আসাদের আন্তর্জাতিক পুনর্বাসন হিসেবে।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের এই ফিরে আসা কীভাবে সম্ভব হলো এবং তার এই প্রত্যাবর্তন সিরিয়া, এই দেশের জনগণ, শরণার্থী এবং গোটা ওই অঞ্চলের জন্য কী অর্থ বহন করে?
বিবিসির আরবি বিভাগের ফেরাসি কিলানি, যিনি ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ার যুদ্ধের ওপর নজর রাখছেন, তিনি এরকম কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ কি শেষ হয়ে গেছে?
আমার মনে হয় আমরা এখন এই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার সূচনা প্রত্যক্ষ করছি।
একনায়ক আসাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া আন্দোলন একসময় নিষ্ঠুর গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। সিরিয়ার বেশিরভাগ এলাকা চলে যায় প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরোধী বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে।
কিন্তু বিরোধী গ্রুপগুলো বর্তমানে তুরস্কের সঙ্গে সীমান্তে খুবই ছোট্ট একটি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০১৭ সালে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের পতনের পর থেকে স্বশাসিত কুর্দি অঞ্চল ছাড়া বাকি সিরিয়া চলে গেছে প্রেসিডেন্ট আসাদের নিয়ন্ত্রণে। বাশার আল-আসাদকে আরব লিগে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি দেশটির বাস্তব পরিস্থিতিরই স্বীকৃতি। এর অর্থ এই নয় যে রাতারাতি অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে।
কারণ এই অঞ্চলে আরও কিছু দেশ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং ইরান সক্রিয় রয়েছে, কিন্তু এখন আমরা যা দেখছি তা হচ্ছে এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার সূচনা।
কীভাবে ফিরে এলেন প্রেসিডেন্ট আসাদ?
আরব দেশগুলোর মধ্যে দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পরেই প্রেসিডেন্ট আসাদের আরব লিগে ফিরে আসা সম্ভব হয়েছে। এই উদ্যোগে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান যিনি এমবিএস নামে পরিচিত।
তার এই প্রত্যাবর্তন ঘটেছে ধাপে ধাপে।
এবং জোটের ভেতরে কিছু বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও বেশিরভাগ আরব দেশ উপলব্ধি করতে পেরেছে যে তারা যেহেতু আসাদ সরকারের পতন ঘটাতে পারেনি, তাই তাদেরকে এখন প্রেসিডেন্ট আসাদকে নিয়েই থাকতে হবে।
মাদকের বিস্তার আর ইরানি প্রভাব মোকাবিলা
এখানে আরও কতগুলো বিষয় কাজ করেছে। প্রথমত ক্যাপটাগন নামের একটি মাদক। এটি এক ধরনের এমফিটামিন। ধারণা করা হয় যে, প্রেসিডেন্ট আসাদ তার দেশে এই ড্রাগটির ব্যাপক উৎপাদনে অনুমতি দিয়েছেন।
ব্রিটিশ সরকারের হিসেবে সারা বিশ্বে যতো ক্যাপটাগন সরবরাহ করা হয় তার ৮০ শতাংশই সিরিয়ায় উৎপাদিত হয়। এর পরে এই ড্রাগটি লেবাননসহ ওই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
শুধুমাত্র ২০২১ সালেই মধ্যপ্রাচ্য এবং তার বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে ৪০ কোটিরও বেশি ক্যাপটাগন ট্যাবলেট জব্দ করা হয়েছে, যা মোট উৎপাদনের সামান্য একটি অংশ বলে ধারণা করা হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে এটা আসলেই বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ, বিশেষ করে সৌদি আরবে। সৌদি আরব মনে করে সিরিয়াকে আরব লিগে ফিরিয়ে নেওয়া হলে এই মাদকের সরবরাহ বন্ধ করা সম্ভব হবে। একইভাবে ইরানকে নিয়েও তাদের উদ্বেগ রয়েছে।
শিয়া-প্রধান দেশ হিসেবে ইরান ইতিমধ্যে ওই অঞ্চলে শক্তি অর্জন করেছে। চারটি আরব রাজধানীতে তেহরানের বড় ধরনের প্রভাবও রয়েছে। এগুলো হচ্ছে - বাগদাদ, বৈরুত, সানা এবং দামেস্ক।
আরব লিগের নেতারা হয়তো হিসেব করে দেখেছেন যে প্রেসিডেন্ট আসাদকে তাদের জোটে ফিরিয়ে নিলে সিরিয়ার ওপর ইরানের প্রভাব হ্রাস পাবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের 'শিয়া বলয়ে' বিঘ্ন সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট আসাদের এই প্রত্যাবর্তনের বিরোধিতা করতে পারে, কিন্তু এবিষয়ে তাদের তেমন কিছু করার নেই।
আরব বিশ্ব মনে করে প্রেসিডেন্ট আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরানো হবে না এবং একারণে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তা চলতে দেওয়া যায় না।
শরণার্থীদের জন্য এর অর্থ কী?
সিরিয়ার যুদ্ধে দেশটির লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। দেশটির অনেকেই এখন সিরিয়ার বাইরে অন্যান্য দেশে বাস করছেন। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে তুরস্ক, লেবানন এবং জর্ডান। অনেকে ইউরোপেও পালিয়ে গেছেন।
দেশের ভেতরেও বহু মানুষ স্থানচ্যুত হয়েছে। শুধুমাত্র ইদলিব এবং আলেপ্পো প্রদেশেই ঘরছাড়া হয়েছে ৩০ লাখ মানুষ। এদের বেশিরভাগই ক্যাম্পে বাস করছেন।
তারা কি এখন সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ফিরে যেতে নিরাপদ বোধ করবেন?
কারণ এই লোকগুলো তো দেশের এই ধ্বংসযজ্ঞ এবং এতো বিশাল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানির জন্য আসাদ সরকারকেই দায়ী করে থাকেন।
আমরা জানি যে জর্ডানে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে সিরিয়ার সরকার তাদের নিরাপদে দেশে ফিরে যাওয়ার কথা বলে তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তাদের ওপর কোনো ধরনের নিপীড়ন চালানো হবে না।
কিন্তু এই আশ্বাসের ওপর কি তারা আস্থা রাখবে? আমি নিশ্চিত নই। আমরা দেখেছি শত শত মানুষ যারা সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ফিরে গেছেন - তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তবে যারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে অথবা ব্রিটেনে চলে গেছে তারা সিরিয়াতে ফিরে আসবে বলে আমার মনে হয় না।
এখনও যেসব জিহাদি আসাদের বিরোধিতা করছে তাদের কী হবে?
প্রথমত তাদের সংখ্যা কতো সেটা আমরা আসলেই জানি না। সিরিয়ার সরকার এবং ইসলামিক স্টেট উভয়ের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে বহু জিহাদি মারা গেছে। ফলে হয়তো আরও কয়েক শ' জিহাদি রয়ে গেছে যারা আল-কায়দা কিম্বা অন্যান্য গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
তাদের ব্যাপারে সিরিয়া ও তুরস্কের মধ্যে আলোচনার প্রয়োজন যাতে করে যারা সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচিত নন তারা যেন দেশে ফিরে যেতে পারেন।
বাকিদের ব্যাপারে তারা হয়তো সামরিক সমাধানের বিষয়ে সম্মত হতে পারেন যেমনটা তারা ইসলামিক স্টেটের বেলায় করেছেন।
বাস্তবতা হচ্ছে এখনও যেসব বিরোধী যোদ্ধা রয়ে গেছে তাদেরকে কীভাবে মোকাবেলা করা হচ্ছে সেটা সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের অবসানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
গোটা অঞ্চলের ওপর কী প্রভাব পড়বে?
সবচেয়ে বড় ও সরাসরি প্রভাব পড়বে লেবাননের ওপর। দেশটিতে ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে চলছে রাজনৈতিক অচলাবস্থাও।
এখন সিরিয়ার এই ফিরে আসার মধ্য দিয়ে হয়তো লেবাননের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
একই সঙ্গে এটাকে যেমন ইরানি প্রভাব ঠেকানোর উদ্যোগ হিসেবে দেখা হতে পারে, তেমনি সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নেও সিরিয়ার এই প্রত্যাবর্তন সাহায্য করতে পারে। প্রেসিডেন্ট আসাদ তেহরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং তার এই পুনর্বাসনের কারণে এই অঞ্চলে উত্তেজনা প্রশমিত হতে পারে।
এছাড়াও ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধের অবসানেও প্রেসিডেন্ট আসাদের এই প্রত্যাবর্তন ভূমিকা রাখতে পারে। এই প্রক্সি ওয়ার বা ছায়াযুদ্ধের কারণেও সাম্প্রতিক কালে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতি বিনষ্ট হয়েছে।
এর অর্থ কি আসাদ যুদ্ধে জিতে গেছেন?
হ্যাঁ, তিনি জয়ী হয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কতো মূল্যের বিনিময়ে? বাস্তবতা হচ্ছে-এই জয় তিনি পেয়েছেন আরও কয়েক বছর আগেই, যখন সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে রাশিয়া পুরোপুরি হস্তক্ষেপ করেছে এবং আইএস পরাজিত হয়েছে।
বলা যেতে পারে, অত্যন্ত চড়ামূল্য দিয়ে এই বিজয় অর্জন করতে হয়েছে। সিরিয়া পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে, ধ্বংস হয়ে গেছে দেশটির অর্থনীতি এবং সিরিয়ার জনগণ ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে।