ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রি করায় কিছু ব্যাংকের ব্যাখ্যা তলব শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক
প্রকাশকালঃ
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৪:৫৫ অপরাহ্ণ ২০৭ বার পঠিত
গত রোববার থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা তলব শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র বলছে, আরও কিছু ব্যাংকের কাছে একই বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হতে পারে।
ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রি করায় বেশ কিছু ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা তলব শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ব্যাংক ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে আমদানিকারক ও করপোরেট গ্রাহকদের কাছে ডলার বিক্রি করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভিযোগ, এসব ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রানীতি ও মুদ্রানীতি পরিপন্থী কার্যকলাপ করছে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
গত রোববার ও গতকাল সোমবার এমন কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। একই কারণে আরও কয়েকটি ব্যাংকের কাছে চিঠি পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। বিভিন্ন সূত্রে যেসব ব্যাংকের নাম জানা গেছে সেগুলো হলো বেসরকারি খাতের মার্কেন্টাইল ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, শরিয়াহভিত্তিক আল-আরাফাহ ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। এসব ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা চিঠি পাওয়ার বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন। তবে তাঁদের কেউই এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
ব্যাংকগুলোকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, আপনাদের ব্যাংকের শাখা পরিদর্শনে আমদানি বিলের বিপরীতে ডলারের দাম ঘোষণার চেয়ে বেশি নেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। ব্যাংকগুলো ডলারের বিপরীতে ঘোষিত দামের চেয়ে কত টাকা বেশি নিয়েছে, তা–ও উল্লেখ করা হয় চিঠিতে। চিঠিতে বলা হয়, এ ধরনের কাজ বৈদেশিক মুদ্রানীতি ও মুদ্রানীতি পরিপন্থী। তাই এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের মতামত জানাতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক ছুটিতে থাকায় এ নিয়ে সংস্থাটির অন্য কেউ কোনো বক্তব্য দেয়নি। সহকারী মুখপাত্র এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে ব্যাখ্যা চাওয়ার বিষয়টি জানা যায়।
চিঠি পাওয়া একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে একাধিক কর্মকর্তা জানান, বাজারে ঘোষিত দামে ডলার পাওয়া যায় না। তাই বেশি দামে ডলার কিনতে হয়। এ জন্য বিক্রির ক্ষেত্রেও বেশি দাম নেওয়া হয়েছে। ব্যাংক সময়মতো আমদানি দায় পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে না। আবার ব্যাংকপ্রতি ডলারে ৪-৫ টাকা লোকসানও করতে পারে না। বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই পদক্ষেপ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ডলারের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে গত বছরের শেষ প্রান্তিক থেকে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) সময়ে–সময়ে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে। চলতি মাসেও ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম বেড়েছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পণ্য বা সেবার রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রের ডলারের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। আগে ব্যাংকগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতি ডলারের জন্য প্রবাসীদের ১০৯ টাকা এবং রপ্তানিকারকদের ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা দিত। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো এখন আমদানিকারকদের কাছে ১১০ টাকায় ডলার বিক্রি করবে। আগে আমদানি দায় মেটাতে ব্যাংকগুলো আমদানিকারকদের কাছে প্রতি ডলার ১০৯ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি করত। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু ব্যাংক প্রতি ডলারে ১১৪-১১৫ টাকা দাম নিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, খাদ্যপণ্যের দাম কেন বাড়ছে, এর ব্যাখ্যা দিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক একটি গ্রুপ সম্প্রতি সরকারের উচ্চপর্যায়ে তার আমদানি খরচের ব্যয় উল্লেখ করে একগুচ্ছ নথিপত্র জমা দেয়। পরে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে একাধিক দল গঠন করে অভিযুক্ত ব্যাংকগুলোর শাখা ও প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করা হয়। এতে ঘোষণার চেয়ে ডলারের দাম বেশি নেওয়ার বিষয়ে তথ্যপ্রমাণও মেলে। এরপরই ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দেওয়া শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘সারা পৃথিবীতে বাজারই ডলারের দাম ঠিক করে। বাংলাদেশে এত দিন ডলার বিক্রি করে দাম ধরে রাখার চেষ্টা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন রিজার্ভ কমে যাওয়ায় সেই পরিস্থিতিও নেই। এখন ব্যাংকগুলোকে দিয়ে একই কাজ করানো হচ্ছে। এভাবে কোনো দেশ ডলারের দাম ধরে রাখতে পারেনি। ব্যাংকগুলো বেশি দামে কিনে কম দামে ডলার বিক্রি করবে, এটা আশা করা ঠিক হবে না। বাজারব্যবস্থা কীভাবে শক্তিশালী ও কার্যকর করা যায়, সেদিকেই নজর দেওয়া উচিত।’
মুস্তফা কে মুজেরী আরও বলেন, ‘এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় আনা কমিয়ে দিতে পারে। প্রবাসীরা ব্যাংকের বদলে হুন্ডিতে অর্থ পাঠাতে বেশি আগ্রহী হবে। এতে আমদানিও কমে যাবে। সার্বিক অর্থনীতি আরও শ্লথ হয়ে পড়বে।’
এর আগে ২০২২ সালে ডলারে অতিরিক্ত মুনাফার অভিযোগে দেশি-বিদেশি ১২ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলারে অতিরিক্ত মুনাফা করা ৫০০ কোটি টাকা সামাজিক দায়বদ্ধতা খাতে (সিএসআর) ব্যয়ের নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।