দেশে আদার চাহিদার বেশির ভাগই আমদানি করে মেটাতে হয়। ডলার সংকট এবং আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় আদা আমদানি কমে গেছে। এতে মসলাজাতীয় এই পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। বাজারে কেরালা জাতের আদা ২৫০ থেকে ৩০০ এবং চীনা আদা ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে।
টিসিবির বাজারদর হিসাবেও আদা ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করা হচ্ছে।
এদিকে ঋণপত্র (এলসি) খোলায় জটিলতা কেটে যাওয়ায় ভারত থেকে প্রচুর আদা আমদানি করা হচ্ছে। তবে চীনা আদার চাহিদা বেশি থাকলেও বুকিং দর বেশি হওয়ায় আমদানিকারকরা এই পণ্যটি আমদানি করছেন না। ভারতের আদা আমদানি শুরু হওয়ায় হিলির বন্দরে কমতে শুরু হয়েছে দাম।
দিনাজপুরের হিলির আমদানিকারকরা পাইকারিতে ভারতের কেরালা জাতের আদা বিক্রি করছেন প্রকারভেদে ১৫০ থেকে ১৭০ টাকায় কেজিতে। তবে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় আদার দাম কমেনি। অবশ্য আমদানিকারকরা বলছেন, শিগগিরই খুচরায়ও আদার দাম কমবে।
হিলি আমদানি ও রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি মো. হারুন অর রশিদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন হিলি বন্দরসহ সব স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ আদা আমদানি করা হচ্ছে।
এতে আদার বাজারে যে অস্থিরতা চলছে, তা দ্রুতই কমে আসবে। হিলি স্থলবন্দরের আমদানিকারকরা আজ (গতকাল) কেরালা আদা পাইকারিতে ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা কেজি বিক্রি করছেন।’
রাজধানীর শ্যামবাজার পেঁয়াজ-আদা-রসুন ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. মাজেদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশের বাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদা চীনা বড় আকারের আদা। দাম বাড়ার কারণে এই আদার আমদানি বন্ধ আছে। চীন থেকে আদা আমদানি করতে গেলে এখন প্রতি কেজি আদায় খরচ পড়বে ৩৩০ টাকার মতো।
এত দামে আমদানি করার সাহস পাচ্ছে না কেউ। তবে ভারত থেকে প্রচুর আদা আমদানি করা হচ্ছে এখন।’
গতকাল রাজধানীর রামপুরা, বাড্ডা ও জোয়ারসাহারা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চীনা আদার সরবরাহ সংকট চলছে। তবে প্রতিটা দোকানেই কেরালা জাতের পর্যাপ্ত আদা আছে। আদার কোনো সরবরাহ সংকট নেই। তার পরও দাম চড়া।
বাড্ডার মেসার্স ভাই ভাই স্টোরের ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাজারে আদার সরবরাহ কম থাকায় আমাদের পাইকারিতেই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। চীনা আদা এখন পাইকারি বাজারের বেশির ভাগ দোকানেই নেই। দুই জাতের কেরালা আদার মধ্যে একটির কেজি ২৬০ টাকা, আরেকটি ৩০০ টাকায় বিক্রি করছি।’
চাহিদা ও আমদানি কত
কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে প্রতিবছর আদার চাহিদা প্রায় দুই লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে দেশে উৎপন্ন হয় ৮০ হাজার মেট্রিক টন। চাহিদার বাকি অংশ আমদানি করা হয় চীন, ভারতসহ কয়েকটি দেশ থেকে। এর মধ্যে চীন থেকে আসে প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি। প্রায় ৪০ শতাংশ আসে ভারত ও মিয়ানমার থেকে।
কৃষি বিভাগের হিসাবে, প্রতি মাসে আদার প্রয়োজন ২০ হাজার মেট্রিক টন। কোরবানির ঈদে চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে যায়। এখন দেখা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সেই আদা এসেছে কি না?
বন্দরের হিসাবে, গত বছর শুধু চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আদা আমদানি করা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৮৭৪ টন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ মে পর্যন্ত আমদানি করা হয়েছে মাত্র চার হাজার ৩৫২ টন। অবশ্য আগামী এক মাসের মধ্যে ১৭০ কনটেইনার আদা চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছবে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পেঁয়াজের মতো আদা উৎপন্নেও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত। যাতে আগামী পাঁচ বছরে দেশেই ব্যাপকভাবে আদার উৎপাদন বাড়াতে পারে। এরই মধ্যে পেঁয়াজ উৎপাদনে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে, ফলে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে। আদার উৎপাদন না বাড়াতে পারলে আমাদের আমদানির ওপরই নির্ভরশীলই থাকতে হবে। এতে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না।’
খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজার
খাতুনগঞ্জের পাইকারি আড়তে এখন দুই দেশের আদা পাওয়া যাচ্ছে। একটি হচ্ছে, মিয়ানমারের আদা; কেজি ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, আরেকটি ভিয়েতনামের আদা; কেজি ২০০ থেকে ২২০ টাকা। পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এই দুই দেশের আদা খুচরায় বিক্রি করা হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৪০ টাকা কেজি। এপ্রিল মাসেও এই আদার দাম ছিল কেজি ১৪০ থেকে ২৫০ টাকায়। তখন অবশ্য দেশীয় আদার সরবরাহ ভালো ছিল। এখন বাজারে দেশি আদা নেই বললেই চলে; চাহিদা মেটাচ্ছে আমদানীকৃত আদা। আর পুরো আমদানিনির্ভরতার কারণেই বাজারে দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক বাজারে আদার দাম
আন্তর্জাতিক বাজারে সর্বোচ্চ চাহিদা থাকে চীনা আদার। বেশ কয়েক মাস ধরে চীনা আদার বুকিং অনেক বেশি। সেখানে প্রতি টন আদার বুকিং দুই হাজার ৬০০ থেকে দুই হাজার ৭০০ মার্কিন ডলার। এখন বাজারে যে আদা বিক্রি করা হচ্ছে সেগুলো বড়জোর এক হাজার ডলারের নিচে কেনা।
এখন দুই হাজার ৬০০ ডলারের সেই আদা আমদানি হয়ে দেশে এলে বাজারে দাম কত পড়বে—জানতে চাইলে অ্যাগ্রো কমোডিটি ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি রেজাউল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডলার বিনিময়মূল্য ১১২ টাকা হিসাব করে প্রতি কেজি আদার কেনা মূল্য পড়বে ২৯১ টাকা। এর সঙ্গে কেজিপ্রতি ২২ টাকা শুল্ককর যোগ করলে দাম দাঁড়াবে ৩১৩ থেকে ৩১৫ টাকা। দেশে এখন পাইকারিতে আদা বিক্রি করা হচ্ছে কেজি ১৮০ থেকে ২২০ টাকায়। ২০০ টাকার ওপরে আদার পাইকারিতে আদার কেজি হলে কেউ কিনবে না। ফলে চীন থেকে কেউ আমদানি করছে না।’
একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোরবানি ঘিরে শুধু চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরাই ভিয়েতনাম এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে ১৫০ থেকে ১৭০ কনটেইনার আদা আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলেছেন। এর বাইরে ভারত ও মিয়ানমার থেকেও আমদানির জন্য বিপুল ঋণপত্র খোলা হয়েছে। কোরবানিতে দাম বাড়তি থাকবে—এমন আশায় শতভাগ মার্জিন দিয়েও এসব আদা আমদানি করছেন; কিন্তু কোরবানির শেষ মুহূর্তে এই চড়া দাম থাকবে কি না সংশয়ে আছি।’
জানতে চাইলে কাঁচা পণ্য আমদানিকারক রেজাউল করিম আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আদা আনার কারণ হচ্ছে দাম কম। চীন থেকে যেখানে দুই হাজার ৬০০ ডলার পাচ্ছি ওই দুই দেশ থেকে পাচ্ছি এক হাজার ৪০০ ডলারে। আর সেখান থেকে জাহাজে করে আসতেও সময় লাগবে ২০ থেকে ২২ দিন, চীনের চেয়েও কম সময়। ফলে কোরবানির ঈদের আগেই সেই আদা দেশে পৌঁছবে। ফলে সরবরাহ সংকটের শঙ্কা আমি দেখছি না।’
টেকনাফ দিয়ে অনেক কম দামে আনার সুযোগ হাতছাড়া
মিয়ানমার থেকে টেকনাফ দিয়ে ঋণপত্রের মাধ্যমে আমদানির সুযোগ নেই। দুই দেশের চুক্তি অনুযায়ী, ব্যাংকের ড্রাফটের মাধ্যমে এই পণ্য আমদানি করা হয়ে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সরকারি ও বেসরকারি দুটি ব্যাংকের মাধ্যমে ড্রাফট খোলার সুবিধা রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। নেতারা এখন ড্রাফটগুলো কমিশনে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা সেই ড্রাফট পাচ্ছেন না। [প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন হিলি প্রতিনিধি]