দেড় শ বছর আগে ১৮৬৯ সালে গড়াই নদের তীরে কুমারখালী পৌরসভার শেরকান্দি এলাকায় গড়ে ওঠে লুঙ্গি বেচাকেনার কাপুড়িয়া হাট।
কাকডাকা ভোরেই শত শত তাঁতি, ফড়িয়া তথা মধ্যস্থতাকারী ও কাছে–দূরের ব্যবসায়ীদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে কুষ্টিয়ার কুমারখালী পৌরসভার ঐতিহ্যবাহী শেরকান্দি কাপুড়িয়া হাট। বেচাকেনা শুরু হয় সকাল ৬টায়, চলে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। ততক্ষণে কমবেশি চার কোটি টাকার লুঙ্গি বিক্রি হয়। তবে অধিকাংশ কেনাবেচাই হয়ে যায় সকাল নয়টার মধ্যে। দেড় শ বছরের পুরোনো এই হাট বসে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার।
সম্প্রতি এক হাটবারে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপ হয় কাপুড়িয়া হাটের সাধারণ সম্পাদক মো. মাসুদ রানার। তখন তিনি জানান, সেদিন প্রায় ৫০ হাজার থান বা ২ লাখ পিস লুঙ্গি বিক্রি হয়েছে। প্রতিটি লুঙ্গির গড় দাম ২২৫ টাকা ধরলে মোট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে ৪ কোটি টাকায়। তবে করোনার আগে আরও অনেক বেশি টাকার লুঙ্গি বিক্রি হতো।
বয়োজ্যেষ্ঠ তাঁতি ও ব্যবসায়ীরা জানান, ১৮৬৯ সালে গড়াই নদের তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠে কুমারখালী পৌরসভা। তখন থেকেই শেরকান্দি এলাকায় যাত্রা শুরু হয় কাপুড়িয়া হাটের। সেই থেকে কুমারখালীর অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হচ্ছে বুননশিল্প। আর এই বুননশিল্পের সুবাদেই কুমারখালী তাঁতশিল্প কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এই হাটে আসা তাঁতি ও ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই কুমারখালী ও খোকসা উপজেলার বাসিন্দা। কুষ্টিয়ার পার্শ্ববর্তী পাবনা, সিরাজগঞ্জসহ দূরদূরান্তের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা এসে নিজেদের পছন্দ ও চাহিদা অনুযায়ী লুঙ্গি কিনে নিয়ে যান।
স্থানীয় তাঁতি ও ব্যবসায়ীরা জানান, করোনার সময় লকডাউনের কারণে বাসসহ অন্যান্য যানবহন চলাচল বন্ধ থাকায় এই হাটে বেচাকেনা কমে একেবারে তলানিতে ঠেকেছিল। পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থা স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকে আবার জমতে শুরু করে হাট। তবে এখনো বেচাবিক্রি করোনার আগের অবস্থায় ফেরেনি। তখন প্রতি হাটে পাঁচ থেকে সাত কোটি টাকার লুঙ্গি বিক্রি হতো।
কাপুড়িয়া হাটে একটি বড় টিনশেড বা আধা পাকা ঘরে বিপুলসংখ্যক দোকানে লুঙ্গি বেচাকেনা হয়। টিনশেড ঘরের চারদিকে গড়ে ওঠা অনেকগুলো ছোট ছোট ঘরেও কেনাবেচা হয়। ইদানীং এই হাটে মান ও আকারভেদে প্রতি থান লুঙ্গি ৬৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায় বেচাকেনা হয়ে থাকে। এক থানে চার পিস লুঙ্গি থাকে।
এই উপজেলায় প্রায় সাত হাজার তাঁতি আছেন। প্রতি হাটে চার থেকে পাঁচ কোটি টাকার লুঙ্গি বেচাকেনা হয়। করোনার আগে লেনদেন আরও বেশি ছিল। তবে ব্যবসা আবার ভালো হতে শুরু করেছে।
বেচাকেনার এক ফাঁকে কুমারখালী উপজেলার সদকী ইউনিয়নের উত্তরপাড়া এলাকার তাঁতি মোক্তার হোসেন প্রথম আলোকে জানান, তাঁর প্রায় ২০০টি আধুনিক তাঁত (পাওয়ার লুম) রয়েছে। ওই দিন তিনি ১ হাজার ৬০ টাকা দরে ১ হাজার ৫০০ থান লুঙ্গি ১৫ লাখ ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। প্রায় প্রতি হাটেই তিনি ১৫–১৬ লাখ টাকার লুঙ্গি বিক্রি করেন।
একই এলাকার আরেক তাঁতি রুহুল আমিন জানান, তিনি একেক হাটে এক হাজারের মতো থান লুঙ্গি বিক্রি করে থাকেন, যার দাম প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টাকা। করোনার আগে অবশ্য আরও বেশি বিক্রি হতো।
ঘাসখাল এলাকার তাঁতি এনামুল হকের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, তাঁর লুঙ্গির থান আকার ও মানভেদে ৬৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। প্রতি হাটে তিনি ৫৫০–৬০০ থান লুঙ্গি বিক্রি করেন।
চাপড়া ইউনিয়নের সাঁওতা গ্রামের ছোট তাঁতি আবদুল লতিফ বলেন, রং ও সুতার দাম বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় লুঙ্গির দাম বাড়েনি। তাই এখন লাভ কম হয়। একেক হাটবারে ৮০০ টাকা দরে ৫০ থানের মতো লুঙ্গি বিক্রি করে তিনি প্রায় ৪০ হাজার টাকা পান।
পাবনার শাহাজাদপুর এলাকা থেকে লুঙ্গি কিনে এনে কুমারখালীর কাপুড়িয়া হাটে বিক্রি করেন মিল্টন হোসেন। তিনি জানান, বিভিন্ন এলাকা থেকে হকাররা এসে তাঁর কাছ থেকে লুঙ্গি কিনে নিয়ে যান। একেক হাটে তাঁর এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকার বিক্রি হয়।
ফড়িয়া রাজু আহমেদ বলেন, বাইরের জেলা থেকে আসা ব্যবসায়ীদের তিনি প্রতি হাটে পাঁচ লাখ থেকে সাত লাখ টাকার মাল কিনে দেন।
এক হাটবারে চট্টগ্রাম থেকে আসা ব্যবসায়ী রায়হান উদ্দিন জানান, তিনি ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার মাল কিনেছেন। প্রতি থানের দাম পড়েছে ৭২০ টাকা থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা। একই দিনে লিমন শেখ নামের আরেক ব্যবসায়ী জানান, তিনি বিভিন্ন দরে প্রায় ১৩ লাখ টাকার লুঙ্গি কিনেছেন।
কুমারখালী তাঁত বোর্ডের উপমহাব্যবস্থাপক মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, এই উপজেলায় প্রায় সাত হাজার তাঁতি আছেন। প্রতি হাটে চার থেকে পাঁচ কোটি টাকার লুঙ্গি বেচাকেনা হয়। করোনার আগে লেনদেন আরও বেশি ছিল। তবে ব্যবসা আবার ভালো হতে শুরু করেছে।