ফুটবলে ১০ নম্বর জার্সি অমরত্ব পেয়েছে পেলের গায়ে। গত রোববার ব্রাজিলে ‘টিভি গ্লোবো’র ‘হু ওয়ান্টস টু বি আ মিলিয়নিয়ার’ অনুষ্ঠানে উঠেছিল পেলের ১০ নম্বর জার্সির প্রসঙ্গ। সংবাদকর্মী জুলি দুত্রা পেলেকে নিয়ে একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে এই অনুষ্ঠানে প্রথম বিজয়ী হন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘১৯৫৮ বিশ্বকাপে ১৭ বছর বয়সী পেলে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হন জার্সি নম্বর...পরে?’
শুধু দুত্রা কেন এই শূন্যস্থানে যে উত্তরটি হবে, তা মোটামুটি সবারই জানা—১০ নম্বর জার্সি। অনুষ্ঠানে বিজয়ীর প্রাইজমানিও পেলের জার্সি নম্বর ১০–এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত—১০ লাখ ব্রাজিলিয়ান রিয়াল। তবে অনেকে ভাবতেই পারেন, এটা কোনো প্রশ্ন হলো, পেলে ১০ নম্বর জার্সি পরে খেলেছেন, সেটা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কার অজানা! সেটা হতে পারে। তবে পেলে ’৫৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের ১০ নম্বর জার্সি পেয়েছিলেন কীভাবে, তা জানেন কজন?
পেলে ’৫৮ বিশ্বকাপে মাঠে নামার আগেই তাঁকে অমিত প্রতিভাধর হিসেবে দেখা হয়েছে। কিন্তু ’৫৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের প্রথম দুই ম্যাচ অস্ট্রিয়া ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বেঞ্চে বসেছিলেন। প্রশ্নটি তাই ওঠে, অমিত প্রতিভাধর হলেও যে ছেলেটিকে বিশ্বকাপে প্রথম দুই ম্যাচে বেঞ্চে বসিয়ে রাখা হলো, সেই ছেলেটিই কীভাবে সেই বিশ্বকাপেই ১০ নম্বর জার্সি পেল? ব্রাজিলের ’৫৮ বিশ্বকাপ দলে প্রতিষ্ঠিত তারকার অভাব ছিল না। মাঝমাঠ-আক্রমণভাগ মিলিয়ে দিদির মতো কিংবদন্তি প্লে–মেকার ছাড়াও ভাভা, জিটো, হোসে আলতাফিনি এবং মারিও জাগালোর মতো খেলোয়াড়েরা ছিলেন। ১৭ বছর বয়সী পেলে তাঁদের ছাপিয়ে কীভাবে ১০ নম্বর জার্সিটি পেলেন?
ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবো’ এই প্রশ্নের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়েছে। ব্রাজিলের বর্তমান ফুটবল কনফেডারেশনের (সিবিএফ) নাম ছিল তখন ব্রাজিল স্পোর্টস কনফেডারেশন (সিবিডি)। সুইডেনে অনুষ্ঠিত ’৫৮ বিশ্বকাপের জন্য সিবিডি ফিফার কাছে খেলোয়াড় তালিকা পাঠালেও কে কোন জার্সি পরে খেলবেন, সেটি খেলোয়াড় তালিকায় উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিল। ১৯৫০ বিশ্বকাপ থেকে প্রতিটি দলের খেলোয়াড় তালিকায় সব খেলোয়াড়ের জন্য নির্দিষ্ট জার্সি নম্বর রাখা বাধ্যতামূলক করেছিল ফিফা।
উরুগুয়ের লরেঞ্জো ভিলিজিও ছিলেন সে বিশ্বকাপে আয়োজক কমিটির সদস্য। তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের জার্সি নম্বর বণ্টনের সিদ্ধান্ত নেন। ব্রাজিলের স্কোয়াডের বেশির ভাগ খেলোয়াড়কেই তিনি চিনতেন। ফিফায় দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের পরিচালকও বলেছিলেন, লরেঞ্জো ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের জার্সি নম্বর বণ্টন করতে পারবেন।
খেলোয়াড়দের পজিশন অনুযায়ী লরেঞ্জো সবাইকেই ঠিকঠাকমতো জার্সি নম্বর বণ্টন করতে পেরেছিলেন, তা কিন্তু নয়। গোলকিপার গিলমার পেয়েছিলেন ৩ নম্বর জার্সি। ৯ নম্বর জার্সি পেয়েছিলেন ডিফেন্ডার জোজিমো এবং ব্রাজিল ফুটবলে ‘ইথিওপিয়ান প্রিন্স’ এবং ‘মিস্টার ফুটবল’ নামে পরিচিত ইনসাইড ফরোয়ার্ড দিদি পেয়েছিলেন ৬ নম্বর জার্সি। আর পেলের হাতে তুলে দেওয়া হয় ১০ নম্বর জার্সি। বাকিটা ইতিহাস!
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে ব্রাজিলের তৃতীয় ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন পেলে। ২-০ গোলে জয়ের সে ম্যাচে জোড়া গোল করেছিলেন ভাভা। আর গারিঞ্চা মাঠে নামার পর তাঁর সঙ্গে জুটি বেঁধে আক্রমণভাগে ‘গ্রেটেস্ট থ্রি মিনিটস ইন দ্য হিস্টরি অব ফুটবল’–এর জন্ম দিয়েছিলেন পেলে। এরপর শেষ ষোলোয় ওয়েলসের বিপক্ষে গোল করলেন, সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক এবং ফাইনালে সুইডেনের বিপক্ষে জোড়া গোল—১০ নম্বর জার্সিকে অমরত্ব দিতে আর কী লাগে!
অথচ আগের বছর (১৯৫৭) কোপা আমেরিকায় দিদি গায়ে ছিল ব্রাজিলের ১০ নম্বর জার্সি। এমনকি ’৫৮ বিশ্বকাপ বাছাই এবং একই বছর প্রীতি ম্যাচেও ব্রাজিলের ১০ নম্বর ছিল দিদির গায়ে। সে সময় রোকা কাপ নামে একটি প্রতিযোগিতা হতো।
অনিয়মিতভাবে ১৯১৪ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এই প্রতিযোগিতায় মুখোমুখি হয়েছে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। অফিশিয়াল এবং আনঅফিশিয়াল হিসাব মিলিয়ে এই প্রতিযোগিতাতেই প্রথম ট্রফি জিতেছে ব্রাজিল জাতীয় দল। আর ১৯৫৭ সালে এই রোকা কাপে ১৩ নম্বর জার্সিতে ব্রাজিলের জার্সিতে অভিষেক হয়েছিল পেলের। কিন্তু পরের ম্যাচেই পাল্টে গেল জার্সি নম্বর। এবার কিংবদন্তির গায়ে উঠল ৮ নম্বর জার্সি।
গ্লোবো জানিয়েছে, ১৯৫৮ সালে ব্রাজিলের ১০ নম্বর জার্সি প্রথম পরা শুরু করেছিলেন ফ্ল্যামেঙ্গো কিংবদন্তি দিদা। তবে বুলগেরিয়া ও করিন্থিয়ান্সের বিপক্ষে ’৫৮ বিশ্বকাপের প্রস্তুতিমূলক ম্যাচে এই জার্সি পরার সুযোগ পেয়েছিলেন পেলে। ’৫৮ বিশ্বকাপেও ব্রাজিল যাত্রা শুরু করেছিল দিদার গায়ে ১০ নম্বর জার্সি চাপিয়ে। কিন্তু লরেঞ্জো ভিলিজিও সম্ভবত বেশ দূরদর্শী লোকই ছিলেন। আগামীর দিনগুলোয় ব্রাজিলের ১০ নম্বর জার্সি কার গায়ে থাকা উচিত—সেটা বুঝতে পেরেই সম্ভবত তিনি বেছে নিয়েছিলেন ফুটবলের ‘রাজা’ পেলেকে!
গত বছর এই ডিসেম্বর মাসেই না–ফেরার দেশে পাড়ি জমানো পেলে নিজেই জানিয়ে গেছেন তাঁর ১০ নম্বর জার্সি পাওয়ার গল্প। ২০১২ সালে ব্রাজিলের ‘স্পোর টিভি নিউজ’কে বলেছিলেন, দুর্ঘটনাক্রমে এই জার্সি পেয়েছিলেন। পেলের ব্যাখ্যা ছিল, ‘১৯৫৮ সালে বিশ্বকাপের ম্যাচে ১০ নম্বর জার্সি পাই। এই জার্সি পরার মতো তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছিল না। আর আমিও দলের সবচেয়ে বয়স্ক খেলোয়াড় ছিলাম না। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে বিশ্বকাপে এই জার্সিটা পেয়েছিলাম।’