কুমিল্লার বধ্যভূমির ইতিহাস

প্রকাশকালঃ ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:৩৮ অপরাহ্ণ ৩৫৯ বার পঠিত
কুমিল্লার বধ্যভূমির ইতিহাস

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস থাকার কারণে পাকিস্তানি  হানাদার বাহিনীর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চলে সেনানিবাসসহ গোটা কুমিল্লায়। মুক্তিযুদ্ধকালীন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ কুমিল্লা শহর এবং আশপাশের বিভিন্ন এলাকার নানা শ্রেণী-পেশার লোকদের হত্যা করে সেনানিবাসে ধরে এনে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এ ছাড়া জেলার সর্বত্র নারকীয় তান্ডবের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাসহ নিরীহ লোকদের গণকবর দেওয়া হয়। এসব গণকবর ও বধ্যভূমির অধিকাংশ এখনও শনাক্ত কিংবা সংরক্ষণ করা হয়নি। অবহেলা-অনাদরে অধিকাংশ বধ্যভূমির স্থান ঝোপ-জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। কোথাও হয়েছে গো-চারণ ভূমি।

জেলা গণপূর্ত বিভাগ সূত্রে জানা যায়, তবে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ১১০ জনের সমাধি সংরক্ষণের জন্য  প্রতিটিতে ২ লাখ করে ২ কোটি ২০ লাখ টাকার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৮টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য প্রতিটিতে ৮০ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা অফিস ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, ১৯৭১ সালে কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের পুরো এলাকাকে পাকিস্তানি বাহিনী বধ্যভূমিতে পরিণত করেছিল। একাত্তরের ২২ মার্চ থেকে ময়নামতি সেনানিবাসে পাকিস্তানের কমান্ডো ও গোলন্দাজ বাহিনী চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের চারদিকে পরিখা খনন করে। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করে। ২৬ মার্চ সকালে ৫৩ ব্রিগেডের গোলন্দাজ ইউনিটের অধিনায়ক লে. কর্নেল ইয়াকুব মালিকের নির্দেশে সেনানিবাসে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। ৩০ মার্চ বিকেলে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক এ কে এম সামসুল হক খান ও পুলিশ সুপার মুন্সী কবীর উদ্দিনকে সেনানিবাসে গুলি করে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর ময়নামতির গোটা এলাকার ঝোপঝাড়, ছোট ছোট টিলা, সমতল ভূমির কাশবনে, ডোবা বা নালার পাশে পাওয়া গেছে অসংখ্য নরকঙ্কাল। রাজনীতিবিদ ভাষাসংগ্রামী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে অমানুষিক নির্যাতনের পর এ ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টেই হত্যা করা হয়। এ ক্যান্টনমেন্টে মোট ১২টি গণসমাধি খনন করে এরই মধ্যে সাত হাজারেরও অধিক নরকঙ্কাল পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সেনানিবাসের ভেতর রয়েছে আরও অনেক গণকবর।  কুমিল্লা সদরের রসুলপুর বধ্যভূমি, যেখানে ৫ শতাধিক নারী-পুরুষকে মাটিচাপা দেওয়া হয়। মুদফফরগঞ্জ বধ্যভূমি, যেখানে ৩৭ জন লোককে হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয়। চান্দিনার হাড়ং বধ্যভূমি, গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার বাড়ির পাশে ছিল পাকবাহিনীর গণকবর। সেখানে ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে গণকবর দেওয়া হয়। কুমিল্লার আমড়াতলি বধ্যভূমি, সেখানে ১৯৭১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর খন্দকার বাড়ির ২৬ জন নারী-পুরুষ-শিশুকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি করে হত্যার পর গণকবর দেওয়া হয়। সদর দক্ষিণের জগতপুর বধ্যভূমি, সেখানে ২৫ জনের গণকবর দেওয়া হয়। রামমালা বধ্যভূমি, নগরীর রামমালা এলাকায় অবস্থিত সার্ভে ইন্সটিটিউটের ভেতরে পুকুর পাড়ে রয়েছে একটি । ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ভোর ৬টার দিকে প্রথমে পাক হানাদার বাহিনী যখন রামমালা এলাকায় আক্রমণ চালায় তখন ওই এলাকার অনেক মানুষ সার্ভে ইন্সটিটিউটের ভেতরে আশ্রয় নেয়। তখন পাকিস্তানি সেনারা ব্রাশ ফায়ার করে গণহারে সাধারণ মানুষ, আনসারদের হত্যা করে। পরে গর্ত করে গণকবর রচনা করে যায় হানাদার বাহিনী।

স্থানীয় সূত্র মতে, এ বধ্যভূমিতে রয়েছে কমপক্ষে ৫শ লোকের সমাধি। কৃষষ্ণপুর ধনঞ্জয় বধ্যভূমি, সদরের পাচঁথুবী ইউনিয়নে কৃষ্ণপুর ধনঞ্জয় এলাকায় এ বধ্যভূমিটি অবস্থিত। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে দুপুরে এ  এলাকায় বসবাসরত শিশু-নারী, কৃষকসহ ৩৭ জন সাধারণ মানুষকে ধরে এনে ব্রাশ ফায়ার করে নির্বিচারে হত্যা করে ঘাতক হানাদাররা। পরবর্তীতে ২০০১ সালের ১৬ জুন জায়গাটি চিহ্নিত করে এখানে একটি স্মৃতি ফলক স্থাপন করে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহমুদ হাছান। লাকসাম বেলতলী বধ্যভূমি ৭১ এর যুদ্ধকালীন সময়ে কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশনের পাশে দক্ষিণে বেলতলীর এ বধ্যভূমিতে কমপক্ষে ১০ হাজার বাঙ্গালিকে নির্মমভাবে হত্যার পর মরদেহ মাটি চাপাঁ দিয়েছিল হানাদার বাহিনী। পাক সেনাদের নিষ্ঠুর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের নিরব স্বাক্ষী লাকসাম রেলওয়ে জংশন কলোনির শ্রীধাম চন্দ্র দাশ তার মামা সুরেন্দ্র দাস ও উপেন্দ্র দাস বাসসকে জানান, পাকিস্তানী বাহিনী ওইসময় সিগারেট ফ্যাক্টরি থেকে নারী-পুরুষের হাজার হাজার মরদেহ নিয়ে বধ্যভূমিতে গর্ত করে মাটি চাপাঁ দিয়েছে।

দাউদকান্দি বধ্যভূমি, মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি ১৯৭১ সালের ২৩ মে রাজাকারদের সহাতায় পাকিস্তানী বাহিনী রায়পুরা গ্রামের ১১ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে গণগবর দেয়।

কুমিল্লা সেনানিবাসের এমআর চৌধুরী গ্রাউন্ডের পাশের বধ্যভূমি, ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ  কুমিল্লা সেনানিবাসে চলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থানরত বাঙ্গালি সেনা কর্মকর্তা, সেনা সদস্য, সেনানিবাসে অবস্থানরত বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ এবং কুমিল্লা শহর থেকে ধরে নেওয়া ব্যক্তিবর্গসহ প্রায় ৫ শতাধিক লোককে সেনানিবাসে হত্যা করা হয়। তবে এ বধ্যভূমিটি সংস্কার করে  সেনানিবাস কর্তৃপক্ষ।

দেবিদ্বার বধ্যভূমি, দেবিদ্বার উপজেলা সদরের ডাক বাংলোর সামনে অবস্থিত বধ্যভূমিটি পাক হায়ানাদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের স্বাক্ষী। ১৯৭১ সালের ২৪ জুলাই পাক হায়ানারা মুরাদনগর উপজেলার বাখরাবাদ গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ১৪২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এর মধ্যে অনেক নারীও নির্যাতনের শিকার হন। পরে আরও ১৯ জনকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে ওই গর্তে মাটি চাঁপা দেওয়া হয়েছিল।

বরুড়া বধ্যভূমি, কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার পয়ালগাছা ইউনিয়নের নারায়ণপুর গ্রামের বটতলিতে যুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ২ সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প আক্রমণ করে। একই দিনে তারা গ্রামে প্রবেশ করে ৬ জন নিরীহ লোককে হত্যা করে। বটতলীর ভয়াবহ যুদ্ধ পাক হানাদার বাহিনীর সাথে সংঘটিত হয় ১৯৭১ সালের ১০ সেপ্টম্বর। পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর রাজাকারসহ শত শত হানাদারের বিরুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধারা পয়ালগাছার বটতলীতে এক সম্মুখ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সে দিন বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ চর্তুদিক থেকে পাক বাহিনীকে আক্রমণ করেন। অবশেষে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাক হানাদার বাহিনী কিছুক্ষণের মধ্যে এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। সে দিনের বটতলীর ভয়াবহ যুদ্ধে শাহাদাত বরণ কারি ৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নারায়ণপুরের মাটিতে একই কবরে সমাধিস্থ করা হয়।

নাঙ্গলকোট বধ্যভূমি, নাঙ্গলকোটের পরিকোট বধ্যভূমিতে নোয়াখালী, নাঙ্গলকোট ও আশেপাশের অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে নিমর্মভাবে হত্যা করে তিনটি কবরে গণ সমাহিত করে পাক হানাদার বাহিনী।

চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারা বধ্যভূমি, ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জগন্নাথদীঘি ইউনিয়নের বেতিয়ারা নামক স্থানে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর ৯ জন বীরযোদ্ধা পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। বেতিয়ারার শহীদদের কবরটি এখন পূর্বেরস্থানে নেই। বেতিয়ারার শহীদদের সমাধিটি মহাসড়ক থেকে একটু পাশে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার শফিউল আহমেদ বাবুল বাসসকে জানান, কুমিল্লায় অনেক গণকবর ও বধ্যভূমি রয়েছে। এর মধ্যে ৩০টির মতো বধ্যভূমি শনাক্ত করা হয়েছে। আরও অনেক বধ্যভূমি রয়েছে। এগুলো শনাক্ত ও উন্নয়নে আমরা কাজ করছি। সরকার অর্থও বরাদ্দ দিয়েছে।

এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক খন্দকার মু: মুশফিকুর রহমান বাসসকে বলেন, সবার সহযোগিতা নিয়ে জেলাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করা হবে। এগুলোর সংস্কার করে ফলক উন্মোচন করা হবে। পাশাপাশি এগুলোর ইতিহাস লিখে আগামী প্রজন্মকে অবহিত করা হবে।