জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনের পরিণতি দেখতে চায় বিএনপি। এমন চিন্তা থেকে যুগপৎ আন্দোলনকে অক্টোবরের মধ্যেই চূড়ান্ত ধাপে নিতে কৌশল ঠিক করছে দলটি। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে সারা দেশে দলের নেতা–কর্মীদের।
সরকার এবার বিনা চ্যালেঞ্জে একতরফা নির্বাচনের দিকে যাতে এগোতে না পারে, সে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করা সম্ভব হবে বলে বিএনপির নেতা–কর্মীদের বড় অংশ মনে করছে। তবে মাঠের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারকে কতটা টলানো যাবে, সেই সন্দেহও রয়েছে বিএনপির ভেতরে।
কারণ, ঢাকায় বড় জমায়েতের মহাসমাবেশ করার পরদিনই গত ২৯ জুলাই রাজধানীর প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে বিএনপির নেতা–কর্মীদের জমায়েত সেভাবে ছিল না। দলটির নগণ্যসংখ্যক নেতা–কর্মী সেদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও পুলিশের মারমুখী অবস্থানের মুখে মাঠে থাকতে পারেননি। সেই পরিস্থিতি ছিল তাঁদের জন্য একটা বড় ধাক্কা। একধরনের হতাশাও তৈরি হয়েছিল এবং একটা ছন্দপতন হয়েছিল এক দফার আন্দোলনে।
অবশ্য অল্প সময়ের মধ্যেই আগস্টে আবার দুই দফায় গণমিছিল–পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করে এক দফার যুগপৎ আন্দোলনে ফিরেছে বিএনপি। এখন দলটি সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর—এই দুই মাসের মধ্যে তাদের আন্দোলনকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর দলটির নেতৃত্বের একধরনের নির্ভরশীলতার বিষয়ও অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ পাচ্ছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল সোমবার মুঠোফোনে বলেছেন, ‘নির্দলীয় সরকার ছাড়া আমরা নির্বাচনে যাব না। এটাই আমাদের চূড়ান্ত অবস্থান। ফলে আমরা এক দফা দাবি আদায়ে দেশের মানুষকে সম্পৃক্ত করার কর্মসূচি নিয়েই এগিয়ে যাব। তবে আন্দোলনের মাঠে পরিস্থিতি কী হয়, তা পর্যালোচনা করেও প্রয়োজন অনুযায়ী কর্মসূচি নেওয়া হবে।’
অক্টোবর টার্গেট কেন
অক্টোবরের মধ্যেই বিএনপি তাদের আন্দোলনকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নেওয়ার কথা বলছে। কারণ, নভেম্বরের ১ তারিখ থেকে জাতীয় নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হবে। ভোট করতে হবে আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে, এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন থেকে।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে নির্বাচন ঠেকানো কঠিন হবে। সে জন্য তফসিল হওয়ার আগেই এক দফা দাবিতে ফয়সালা চাইছেন তাঁরা।
কী হবে সেপ্টেম্বর–অক্টোবরে
এই দুই মাসে বিএনপি কী করবে বা কী করতে পারবে—এখন এই প্রশ্নেই আলোচনা ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন মহলে। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। দলটি সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকেন্দ্রিক কর্মসূচির পরিকল্পনা করছে। এরপর সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এক দফার আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার চিন্তা তাদের রয়েছে।
সেপ্টেম্বরে একটা পর্যায় পর্যন্ত গণমিছিল, পদযাত্রা ও সমাবেশের মতো যুগপৎ কর্মসূচির পরিকল্পনা করছে বিএনপি। সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘিরে অবস্থান ও অবরোধ কর্মসূচি নেওয়ার চিন্তাও তাদের রয়েছে। তবে টানা এ ধরনের কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার সময়টাকে বিএনপি নেতারা একটা ‘বিশেষ ক্ষণ’ বা সময় হিসেবে উল্লেখ করছেন।
দলটির নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, কর্মসূচি অব্যাহত রেখে তাঁরা এই বিশেষ সময়ের জন্য অপেক্ষা করবেন। তাঁরা মনে করেন, আন্দোলনের মাঠেই টানা কর্মসূচি দেওয়ার বিশেষ ক্ষণ চলে আসবে। আবার দলের নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকেই ঢাকাকেন্দ্রিক টানা কর্মসূচি দিয়ে অক্টোবরে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে নেওয়ার চেষ্টা তাঁদের থাকবে। এ লক্ষ্যে দলটি প্রস্তুতিও নিচ্ছে।
খুলনা থেকে বিএনপির নেতা নজরুল ইসলাম (মঞ্জু) বলেন, ‘সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপে সর্বশক্তি নিয়োগের জন্য দলের তৃণমূলে বার্তা দেওয়া হয়েছে। আমরা মাঠে সেই প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
খুলনা ছাড়াও চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর ও বরিশাল—এসব বড় শহরে বিএনপির জেলা–মহানগর ও ইউনিয়ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁরা সবাই দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে একই ধরনের বার্তা পাওয়ার কথা বলেছেন। প্রয়োজনে ঢাকায় কর্মসূচির জন্য আসতে হতে পারে, এমন প্রস্তুতিও রাখছেন তৃণমূলের নেতা–কর্মীরা। রাজশাহী থেকে বিএনপির একজন নেতা জানিয়েছেন, রাজধানীকেন্দ্রিক কর্মসূচিতে সরকার দমন–নিপীড়ন বাড়িয়ে দিলে অল্প সময়ের নোটিশে একেবারে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত কর্মসূচি পালনেরও প্রস্তুতি রাখতে বলা হয়েছে।
বিশেষ ক্ষণ বা সময়ের বিষয় কেন আসছে
বিএনপি নেতারা মনে করেন, অবস্থান বা অবরোধের মতো কর্মসূচি লম্বা সময় ধরে চললে তাতে সহিংসতা হওয়ার সুযোগ থাকে এবং এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মানুষের মধ্যে। সে জন্য তাঁরা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে অল্প সময়ের জন্য কঠোর কর্মসূচি নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। এ ক্ষেত্রে বিদেশিদের কাছে যাতে নেতিবাচক ধারণা না হয়, সেটি বিবেচনায় রাখছেন বিএনপির নেতৃত্ব।
কিন্তু দলটির নেতারা মনে করছেন, এক দফার আন্দোলনে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে তাঁদের সব কর্মসূচিতেই জমায়েত বাড়ছে। তবে এটি মূলত তাঁদের দলের নেতা–কর্মীদের জমায়েত। সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকলেও সাধারণ মানুষ এখনো বিএনপির আন্দোলনে সরাসরি সেভাবে সম্পৃক্ত হচ্ছে না। এ ছাড়া সরকারের প্রতি এখনো পুলিশ ও প্রশাসনের পুরো সমর্থন রয়েছে।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ একাধিক নেতা বলেছেন, সেপ্টেম্বরে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থেকে তাঁরা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে চান, যার প্রভাবে বিভিন্ন মহলের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও তাঁদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবে। এই বিশেষ সময়ের জন্যই তাঁরা অপেক্ষা করছেন।
বিএনপি নেতা আবদুল মান্নান
ইউনিয়ন, জেলা, মহানগর থেকে শুরু করে দলটির কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত অনেক নেতার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তাঁদের বড় অংশ মনে করেন, অক্টোবরেই এ ধরনের একটা পরিস্থিতি তৈরি করা সম্ভব হবে এবং তাঁদের আন্দোলন ইতিবাচক পরিণতির দিকে যেতে পারে। কারণ, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো এবার আওয়ামী লীগের পক্ষে একতরফা নির্বাচন করা বেশ কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়া থেকে সরকার এবার চাপে রয়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলেছে। এ ছাড়া মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে মানুষের মধ্যে সরকারবিরোধী মনোভাব ও ক্ষোভ বাড়ছে।
তবে মাঠের আন্দোলনে সরকার পরিবর্তন কতটা সম্ভব হবে, সেই প্রশ্নও রয়েছে বিএনপির তৃণমূলসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু নেতা–কর্মীর মধ্যে। বগুড়ায় বিএনপির শক্ত সাংগঠনিক অবস্থান রয়েছে, সেই জেলার একটি ইউনিয়নের বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগের দুটি নির্বাচন আন্দোলন করে ঠেকানো যায়নি। এখনো আন্দোলনের মাধ্যমে এক দফার দাবি আদায় করা কতটা সম্ভব হবে, তা সময় বলে দেবে। আমি মনে করি, বহির্বিশ্ব আরও চাপ সৃষ্টি করে এগিয়ে এলে তখন সম্ভব হতে পারে।’
যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন প্রশাসন সারা বিশ্বে তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখার বিষয় সামনে রেখেছে। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে বিধিনিষেধ দিয়ে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। যা আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর একধরনের চাপ তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপকে বিএনপি তাদের পক্ষে একধরনের সমর্থন হিসেবে দেখছে।
দলটি মনে করছে, নির্বাচন ঘনিয়ে এলে সরকারের ওপর বিদেশি চাপ আরও বাড়তে পারে। এমন পটভূমিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর দলটির নেতৃত্বের একধরনের নির্ভরশীলতাও কাজ করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির এবার আন্দোলনে জেতাটাই একমাত্র লক্ষ্য। কারণ, এবার বিএনপিকে ছাড়া সরকার যদি নির্বাচন করতে পারে, তাহলে দলটি অস্তিত্বসংকটে পড়তে পারে। এ বিষয়টি বিএনপির নেতৃত্বও বিবেচনায় নিচ্ছে বলে দলটির নেতাদের অনেকে বলছেন।