ফিলিস্তিনের শান্তির প্রতীক্ষা

প্রকাশকালঃ ১৪ অক্টোবর ২০২৩ ০১:৫৭ অপরাহ্ণ ২৬৬ বার পঠিত
ফিলিস্তিনের শান্তির প্রতীক্ষা

সমানীয় শাসনের শেষ দিকে ফিলিস্তিনের অধিকার নিয়ে ইহুদিদের ষড়যন্ত্র চলছিল। ঋণচাপে জর্জরিত উসমানীয় সাম্রাজ্যকে আর্থিক সহযোগিতার বিনিময়ে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের জমি ক্রয় ও ইহুদিদের বসতি গড়ার অনুমোদন নেওয়ার চেষ্টা করেন ইহুদিবাদী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা থিয়োডর হার্জেল (Theodor Harzl)। কেননা সে সময় সালতানাতের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের স্থায়ী বসবাস নিষিদ্ধ ছিল। ১৮৯৬ সালের ১৮ জুন হার্জেলের প্রস্তাবের জবাবে উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ বলেছিলেন, ‘আমি দেশের এক কদমও বিক্রি করতে পারব না।

কেননা তা আমার নয়; বরং আমার জাতির। আমার জাতি রক্ত দিয়ে এই ভূখণ্ড অর্জন করেছে এবং রক্ত দিয়ে এর সুরক্ষা করবে। লাখ লাখ ইহুদির সুরক্ষার জন্য আমাদের কাছ থেকে তা আত্মসাৎ করার অনুমোদন পাবে না। অবশ্য এই অঞ্চল বিভক্ত হয়ে পড়লে বিনিময় ছাড়াই ইহুদিরা ফিলিস্তিন অর্জন করতে পারবে। আর ফিলিস্তিন কেবল আমাদের লাশের ওপরই বিভক্ত করা সম্ভব।’

কিন্তু হার্জেল বারবার একই প্রস্তাব পাঠালে আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমরা আমাদের দেশের এক বিঘা পরিমাণ জমি নিয়েও আপস করব না, বরং এসব অর্জনে আগে আমরা যে পরিমাণ রক্ত ব্যয় করেছি এখন তার চেয়েও বেশি ব্যয় করব। আমি সব নাগরিকের মধ্যে সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তবে আমাদের মুসলিম পূর্বপুরুষদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কখনো হ্যাঁ বলতে পারব না।


তিনি আরো বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাদের মাধ্যমে অন্যান্য নাগরিকের মতোই সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছ, বরং অন্যদের চেয়েও অনেক বেশি আরাম-আয়েশে রয়েছ। তোমরা কি ওই সব অস্থিরতা ও নিপীড়নের কথা ভুলে গেছ, যা বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটেছিল? অথচ এখন তোমরা আমাদের মায়ের কোলে রয়েছ?’ (সুলতান আবদুল হামিদ আল-সানি ওয়া ফিলিস্তিন, রফিক শাকির নাতশা)

১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব আর্থার জেমস বেলফোর ইহুদি নেতা ব্যারন রথচাইল্ডের কাছে মাত্র ৬৭ শব্দের একটি সংক্ষিপ্ত চিঠি লেখেন। এর ভাষ্য ছিল, ‘মহামান্য (ব্রিটিশ) সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য জাতীয় আবাসভূমি গড়ে তোলার বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। আর এই লক্ষ্য অর্জনে তার সর্বোত্তম প্রয়াস প্রয়োগ করা হবে এবং এটাও পরিষ্কার যে এখানে এমন কিছু করা হবে না, যা ফিলিস্তিনে বিদ্যমান অ-ইহুদি সম্প্রদায়ের নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকার কিংবা অন্য কোনো দেশে ইহুদিদের বিরাজমান অধিকার ও রাজনৈতিক অবস্থান ক্ষুণ্ন করতে পারে।’ আকারে ছোট হলেও তাতে ‘ইহুদি জনগোষ্ঠীর জাতীয় ভূমি প্রতিষ্ঠার’ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।


‘বেলফোর ঘোষণা’ নামে পরিচিত এই চিঠির প্রভাব এতটাই তীব্র ছিল যে ১০০ বছর পরও এর সংকটে ফিলিস্তিনি আরবরা ভুগছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় সাম্রাজ্য পরাজিত হয়। ৪০০ বছরের বেশি সময় উসমানীয়দের শাসনাধীন থাকার পর ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং এর নাম রাখে ‘ম্যান্ডেটরি প্যালেস্টাইন’। মূলত ১৯১৮ সাল থেকে ৩০ বছর ব্রিটিশের অধীনে থাকাকালে ফিলিস্তিনে ইউরোপ থেকে প্রায় চার লাখ ইহুদির আগমন ঘটতে থাকে। পাশাপাশি হাগানাহসহ বিভিন্ন ইহুদি মিলিশিয়া গোষ্ঠীর মাধ্যমে আরব ফিলিস্তিনিদের নিজ বসতি থেকে উচ্ছেদ করা হয়।

জাতিসংঘের উদ্যোগে ফিলিস্তিনের বিভক্তি : ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘ ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শেষ হওয়ার পর তা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্ত করার প্রস্তাব উত্থাপন করে। ১৮১(২) প্রস্তাব নামে পরিচিত এই প্রস্তাবে স্বাধীন আরব ও ইহুদি রাষ্ট্র তৈরি এবং জেরুজালেম শহরের জন্য বিশেষ আন্তর্জাতিক শাসন চালুর সুপারিশ করা হয়। এতে ফিলিস্তিনের ৬ শতাংশ ভূমি ৩৩ শতাংশ ইহুদিকে দেওয়া হয় এবং ৯৪ শতাংশ জমি ৬৭ শতাংশ ফিলিস্তিনিকে দেওয়া হয়। তা ইহুদিদের কাছে গৃহীত হলেও আরব নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। জাতিসংঘের এই পরিকল্পনা কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা এই সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হয়ে ফিলিস্তিন ছাড়ে। ১৪ মে ইহুদি নেতারা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় এবং ডেভিড বেন গুরিয়ন প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এরপর ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হয়। পরদিনই প্রতিবেশী আরবদেশও এতে অংশ নেয়। তখন ইহুদিরা ফিলিস্তিনের ৭৮ শতাংশ দখল করে। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১৯৪ রেজল্যুশন পাস হয়, যাতে শরণার্থী ফেরার অধিকার বিষয়ে আহ্বান জানানো হয়। পরের বছর মিসর, লেবানন, জর্দান ও সিরিয়া যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। 


অসলো চুক্তি : ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে গাজা উপত্যকায় প্রথম ইন্তিফাদা শুরু হয়। ১৯৮৮ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনকে (পিএলও) ফিলিস্তিনি জনগণের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয় আরব লীগ। ১৯৯৩ সালে নরওয়ের রাজধানী অসলোতে ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অসলো চুক্তি স্বাক্ষর ও প্যালেস্টাইন অথরিটি (পিএ) গঠনের মাধ্যমে শেষ হয় ইন্তিফাদা। এই চুক্তির জন্য পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেও ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সশস্ত্র হামলা চলমান থাকে। এই চুক্তি অনুসারে ফিলিস্তিনিরা স্বশাসনের আংশিক অধিকার পাবে এবং ইসরায়েল প্রথমে পশ্চিম তীরে, অতঃপর গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করবে। এর বদলে ইসরায়েলি রাষ্ট্রের বৈধতা স্বীকার করে নেবে পিএলও।

আরব শান্তি উদ্যোগ : ২০০২ সালের মার্চে বৈরুতে আরব লীগের ১৪তম শীর্ষ সম্মেলনে সৌদি আরব আরব পিস ইনিশিয়েটিভ (এপিআই) উত্থাপন করে। এতে পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা, গোলান ভূমি, লেবাননের ভূমিসহ ইসরায়েল কর্তৃক দখলকৃত স্থান পুরোপুরি প্রত্যাহার এবং জাতিসংঘের ১৯৪তম ধারা মতে, ফিলিস্তিন শরণার্থী সমস্যার ন্যায্য নিষ্পত্তি ও পশ্চিম জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করার কথা বলা হয়। দাবিগুলো পূরণ হলে আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরিতে আর কোনো বাধা থাকবে না বলে উল্লেখ করা হয়।

তবে ইসরায়েলকে ’৬৭-এর সীমানায় ফিরতে বলায় তৎকালীন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন উদ্যোগটিকে ‘নন স্টার্টার’ অভিহিত করে তা প্রত্যাখ্যান করেন। ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে বাংলাদেশসহ ৫৭টি রাষ্ট্র এবং বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রপ্রধান এই উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও তা বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। সম্প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে আরব আমিরাতের স্বাভাবিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ আগস্ট আরব পিস ইনিশিয়েটিভের আলোকে ফিলিস্তিন সংকট সমাধানের ঘোষণা দেন সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান। এর পর থেকে আবারও তা মুসলিম বিশ্বের আলোচনায় আসে। এবার কি ফিলিস্তিনিদের শান্তির প্রতীক্ষা শেষ হবে?