অভিভাবকের শিশুশিক্ষায় করণীয় কী?

প্রকাশকালঃ ১৩ জুন ২০২৩ ০৬:৪৯ অপরাহ্ণ ১৯৩ বার পঠিত
অভিভাবকের শিশুশিক্ষায় করণীয় কী?

নে পড়ে, ছোটবেলায় মাছ খেতে চাইতাম না। মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে বাবা বাসায় আসার সুযোগ পেতেন। নব্বইয়ের দশক। মফস্বল শহর। ক্যাম্পাসেই বাসস্থান ছিল বলে বাবা সেই সময়টুকু ব্যয় করতে পারতেন একমাত্র কন্যার সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলার কাজে। নিজে চটজলদি খেয়ে নিতেন, তার সঙ্গে বসে আমার অপছন্দের খাবারগুলোও গল্পে গল্পে খেয়ে নিতাম।

রাতেও গল্প শোনাতেন বাবা। মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। বাবার সঙ্গে সন্তানের গুণগত সময় কাটানো নিয়ে লিখতে বসে প্রথমে সেসব দিনের কথাই মনে এলো। ইচ্ছা থাকলে কিন্তু আজকের বাবারাও নিজেদের কাজের সময়ের মধ্যেই এমনিভাবে যুক্ত করে নিতে পারেন সন্তানকে। সন্তানপালন তো কেবল মায়ের দায়িত্ব নয়, বাবার ভূমিকাও এখানে সমান গুরুত্বপূর্ণ। ব্যস্ত বাবার জীবনে এ-ও যে এক মস্ত কাজ।

আবার এমনও দেখা যায়, অনেক পরিবারেই বাবা-মায়ের ভালবাসা ও সন্তানকেন্দ্রিক নির্ভরতা বাড়তে বাড়তে এমন এক স্তরে পৌঁছায়, যেখানে বাবা-মা সন্তানের কাছে প্রায় জিম্মি হয়ে যাচ্ছেন। সন্তান বড় হওয়ার পাশাপাশি বাবা-মাকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখছে,  মত প্রকাশ করছে; কিন্তু নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বিশেষ করে এ সময়ের ধনী ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে দেখা যায়, অনেক মা-বাবাই সন্তানের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় চালিত হচ্ছেন বা চলতে বাধ্য হচ্ছেন। এখন প্রায় সব ঘরেই একজন বা দুজন করে সন্তান এবং এই চোখের মণিদের বাবা-মায়েরা সাধ্যমতো বা সাধ্যের বাইরে গিয়েও ভালো রাখার চেষ্টা করেন।


সন্তান বড় করার সময় আমরা প্রায় সবাই তাদের রূপকথার গল্প শুনিয়ে বড় করি। বলি যে, তোমরাই আমাদের গল্পের রাজপুত্র, রাজকন্যা। তোমাদের চাওয়া-পাওয়া, ভালো থাকা, বড় হওয়াই আমাদের কাছে সব। আধুনিককালের অনেক অভিভাবক শত কষ্ট হলেও বুঝতে দিতে চান না তাদের প্রকৃত সামর্থ্য কতটা। বুঝতে দিতে চান না বাবা-মা তাদের কতটা দিতে পারবেন,  বাবা-মায়ের কাছে তাদের কতটা চাওয়া উচিত।

আমাদের জীবন এখন জীবিকাপ্রধান। কেবল কাজ আর কাজ। অনলাইন কাজ, অফলাইন কাজ। অনেকেরই আবার বেশ কিছুটা সময় চুরি করে নেয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সপ্তাহান্তে ক্ষণিকের অবসরটুকু ছাড়া আজকের বাবা হয়তো নিজেকে নিয়ে ভাবারও সময় পান না। অফিস ৯টায় হলে কী হবে, জ্যামের যন্ত্রণায় হয়তো ঘর থেকে বের হচ্ছেন আরও ঘণ্টা দুই আগে, সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার তাড়াও থাকতে পারে। তবে এত কিছুর মধ্যেও বেড়ে ওঠার রঙিন সময়ে বাবার আঙুল ধরার সুযোগ প্রতিটি সন্তানেরই থাকা দরকার।

সন্তানের কাছে নানাভাবে প্রকাশ করতে হবে যে আমরা তাদের ভালবাসি, স্নেহ করি, তার অভিমতকে সম্মান করি। সন্তানের ভালোর জন্য, খুশির জন্য বাবা-মা অবশ্যই সর্বোচ্চটা করার চেষ্টা করবেন, কিন্তু সেটা যেন সাধ্যের বাইরে গিয়ে না হয়।


শিশু সুন্দর কিছু বা অন্য বন্ধুর মতো কিছু কোনো জিনিস চাইতেই পারে, না দিলে জেদ করতে পারে, কাঁদতে পারে বা মন খারাপ করতে পারে। কিন্তু এর বেশি কিছু যেন না করে, সেটা বাবা-মাকেই বোঝাতে হবে। যখন তখন যেকোনো কিছু সন্তানের সামনে হাজির করলে তা বুমেরাং হয়ে উঠতে পারে।

একটা বয়স পর্যন্ত মা-বাবা সন্তানকে অতিরিক্ত আহ্লাদ-আদর দেন। যা চায়, তাই দেওয়া হয়। এরপর সন্তান যখন বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছে, তখনই শুরু হয় সংঘাত। তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্তানের দাবি দাওয়া ও চাহিদার সঙ্গে অভিভাবকের মতের মিল নাও হতে পারে। এদিকে শিশু এটা জেনেই বড় হয় যে, তার অবস্থান পরিবারে একচ্ছত্র, তার চাওয়াই বাবা-মায়ের কাছে শেষ কথা। সে যেভাবে বলবে, তাই হবে। ফলে, এর কোনো ব্যত্যয় হলে অভিভাবকের সঙ্গে সন্তানের দ্বন্দ্ব শুরু হয়, বাড়ে মানসিক দূরত্ব। বাবা-মা যখন তার চাহিদা মেটাতে পারেন না বা কম পারেন, তখনই ছেলেমেয়েরা নানাভাবে বিপৎগামী হয়ে যেতে পারে। এই চাওয়া ও পাওয়ার ফাঁক দিয়ে সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের মানসিক যোগাযোগ কমে যায়।

আবার মন্দ কাজের ক্ষেত্রে 'না' বলার মাধ্যমে বা 'স্পষ্ট করে কথা বলা'র মাধ্যমেও তাদের প্রত্যুত্তর দেওয়া যেতে পারে। সন্তান যেন বুঝতে পারে, তার এই আচরণ বাবা-মায়ের পছন্দ হয়নি বা কাঙ্ক্ষিত নয়। এভাবে সে তার আচরণ, জেদ, চাহিদাকে সংযত করতে শিখবে। সন্তানের অন্যায় চাহিদা ও সেটাকে কেন্দ্র করে বেয়াদবি করাকে একেবারেই প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। আচরণ যদি অতিরিক্ত অগ্রহণযোগ্য হয়, তখন তার আদর-ভালবাসাসহ প্রাপ্য সুবিধা কমিয়ে দিতে হয়।


সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলুন। হয়ে উঠুন তার ভরসার জায়গা। শিশুর সঙ্গে কথা বলুন নিয়মিত। ভাগ করে নিন নিজের কথা। আপনার শৈশব কেমন ছিল, ওর বয়সে আপনি কী করতেন, এমন নানান কথা আলাপ করুন। ওকে নিয়ে বই পড়ুন, ওর সঙ্গে ছবি আঁকুন কিংবা খেলুন। 

বাইরে নিয়ে যেতে পারলে সবচেয়ে ভালো, সম্ভব না হলে ঘরেই খেলুন, তবে ডিজিটাল মাধ্যমে নয়। হতে পারে সেটা শব্দ খুঁজে বের করা কিংবা ছন্দ মেলানোর খেলা। ছোট বাসা! তাতে কী? একটা বারান্দাই হয়ে উঠতে পারে ওর স্টুডিও। সেখানেই চলুক না আঁকিবুঁকি। আপনিও যোগ দিন। কিংবা ওকে নিয়ে বাগান করুন। ওকে সঙ্গে নিয়ে ঘরের কাজও করুন। সব বাবা হয়তো দুপুরে সময় পাবেন না, তবে রাতের খাবারটা অন্তত সন্তানের সঙ্গে বসে খেতে চেষ্টা করুন। সপ্তাহান্তে তাকে ঘুরতে নিয়ে যেতে পারেন।

অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখান। অসহায় মানুষ আর প্রাণীদের জন্য কিছু করতে উৎসাহ দিন। বাবা হয়তো আর্থিক সহায়তা করছেন কাউকে কিংবা খাবার দিচ্ছেন, এই কাজটুকুই ওর হাত দিয়ে করান। পথের প্রাণীদের ভালোবাসতে শেখান। শিশুর মনটা উদার হবে।


অন্যের প্রতি সম্মানবোধের প্রথম শিক্ষাটা শিশু পরিবার থেকেই পায়। শিশুর সামনে কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করবেন না। কেউ খাটো, কেউ লম্বা, কেউ ফর্সা, কেউ কালো; আবার কেউ ছেলে, কেউ মেয়ে। লিঙ্গভেদ কিংবা শারীরিক গড়ন স্রষ্টার দান। কাউকেই ছোট করে দেখতে নেই, মনে আঘাত দিয়ে কথা বলতে নেই। ছোট থেকেই এসব স্বাভাবিক বিষয় অঙ্কুরিত করে দিন সন্তানের মনে।

মায়ের প্রতি বাবার আচরণ দেখে শিশু সামাজিক পরিসরে নারীর অবস্থানের প্রাথমিক ধারণা পায়। মা-বাবার দাম্পত্যজীবন পরবর্তীকালে তার দাম্পত্যজীবনেও প্রভাব ফেলে। বিশেষত কন্যাশিশু পরবর্তী জীবনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মস্থলে কিংবা শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতে পারে। স্বাধীন দেশের পরাধীন নাগরিক হিসেবে আপনার সন্তান বেড়ে উঠুক, এমনটা নিশ্চয়ই চাইবেন না। তাই সন্তানকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলুন, পারিবারিক সম্প্রীতি বজায় রাখুন।

পথ চলতে গিয়ে অচেনা নারীর প্রতি বাবার আচরণ কেমন, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত পুত্রসন্তানের জন্য। বাবা যদি অচেনা নারীর প্রতি সম্মানজনক আচরণ করেন, পথ ছেড়ে দেন, আগে যেতে দেন, গণপরিবহনে নারী ও বয়স্কদের আসন ছেড়ে দেন এবং অচেনা নারীর চলার পথে অস্বস্তির কারণ হয়ে না দাঁড়ান, তা দেখে সন্তানও বড় হতে হতে এসব গুণ রপ্ত করে ফেলবে।


আসল কথা হলো, সন্তানকে জীবনে চাহিদার ব্যাপারটা বুঝতে দিতে হবে। সেইসঙ্গে বুঝাতে হবে, কোনোকিছু পাওয়ার বা অর্জনের সুখ। বর্তমান সময়ে অনেক অভিভাবক সন্তানকে প্রয়োজনের তুলনায় এতো বেশি সুখ দেওয়ার চেষ্টা করেন যে শান্তিটা চলে যায়। অতিরিক্ত পেয়ে গেলে সন্তান পাওয়ার সুখটা বুঝতে চেষ্টা করে না, শেখে না ধন্যবাদ দিতে। মনে করে, এই পাওয়াটা তাদের অধিকার। আর কিছু দিতে না পারাটা হয়ে দাঁড়ায় বাবা-মায়ের ব্যর্থতা।

সাধ্যের মধ্যেই আছে সব সত্য। সন্তানকে বাবা-মায়ের সক্ষমতা ও অপারগতা বুঝতে হবে। সেইসঙ্গে পরিবার, বাবা-মা ও সমাজের প্রতি একটা দায়িত্ববোধ তৈরি হতে হবে। সন্তান যেন শুধু নিজের ইচ্ছা, নিজের প্রয়োজন, উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিতে না শেখে।

আমরা যারা জীবনের অনেকগুলো বছর পার করে এসেছি, বাবা-মা হয়েছি, সন্তানকে বড় করেছি, যুগের নানান পরিবর্তনের ধারায় নিজেরাও পরিবর্তিত হয়েছি; তবে সবসময় চেষ্টা করেছি যেন সন্তানের ইচ্ছা-চাহিদা-শখের কাছে জিম্মি হয়ে না পড়ি। যেমনটা জিম্মি হননি আমাদের অনেকের পূর্বসূরি। সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের সম্পর্কটা উভয় দিক দিয়েই হবে আদর, ভালোবাসা, নিরাপত্তা, আশ্রয়-প্রশ্রয়, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের; জিম্মি করার নয়।