একটি সুন্দর রেজাল্ট কার্ডের চেয়ে একজন সার্থক শিক্ষার্থীই বেশি মূল্যবান।
প্রত্যেক অভিভাবকেরই স্বপ্ন থাকে তাঁর সন্তান যেন শিক্ষা, আচরণ, মেধা ও মননে একজন সুনাগরিক হয়ে গড়ে ওঠে। শুধু মেধাবী নয়—যোগ্য, আত্মবিশ্বাসী ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত মানুষ হিসেবে সন্তানকে দেখতে চান সকল পিতা-মাতা। কিন্তু এই প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে প্রথমেই অভিভাবকদের হতে হবে সচেতন ও দায়িত্বশীল। কারণ, যোগ্য অভিভাবকই পারেন সন্তানের সফলতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে।
আজকের দিনে অনেক অভিভাবক শুধু পরীক্ষার ভালো ফলাফলের দিকেই নজর দেন; কিন্তু প্রতিষ্ঠানের দেওয়া প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা, নিয়মনীতি বা শিক্ষকের পরামর্শ অনুসরণ করেন না। এতে কাঙ্ক্ষিত ফল আসে না।
সন্তানের কল্যাণে কয়েকটি প্রশ্ন ভাবা জরুরি—
সে কি নিয়মিত স্কুলে যায়?
পূর্বের ফলাফল বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করা হয়েছে কি?
অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া হয় কি?
ভার্চুয়াল দুনিয়া বা ইন্টারনেটে আসক্তি তৈরি হচ্ছে কি না তা দেখা হচ্ছে কি?
নিয়মিত পড়ার টেবিলে বসে পড়া হচ্ছে কি?
আত্মীয়ের বাড়ি বা উৎসব উপলক্ষে অতিরিক্ত বেড়ানোয় পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে কি না?
এসব বিষয়ে অবহেলা করলে কেবল ভালো রেজাল্টের আশায় বসে থাকা অর্থহীন।
ভালো রেজাল্ট আর ভালো শিক্ষার্থী—এই দুটি এক নয়। যারা স্কুলের ডাকা অভিভাবক সভায় অনুপস্থিত থাকেন, তারাই সন্তানের অগ্রগতি নিয়ে বেশি হতাশ হন। তাই প্রতিষ্ঠানের নিয়ম, পাঠদান পদ্ধতি, পরীক্ষার ধরন, রেজাল্ট প্রস্তুতির নিয়ম ইত্যাদি বিষয়ে জানার জন্য অভিভাবক সভায় উপস্থিত থাকা জরুরি। সন্তানের কল্যাণে অন্য কাজ পরে রেখে প্রথমে এসব সভায় যোগ দিন।
শিক্ষকের সঙ্গে অভিভাবকের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ একটি শিশুর বিকাশের জন্য অপরিহার্য। যখন পরীক্ষার ফলাফল বা রিপোর্ট কার্ড বিতরণ হয়, তখন তা শুধু নাম্বারের হিসাব নয়—এতে শিক্ষার্থীর শেখার অগ্রগতি, দুর্বলতা ও সম্ভাবনার প্রতিবিম্ব থাকে। তাই ফলাফল বুঝে নেওয়া, শিক্ষককে শোনা, ও সন্তানের দুর্বলতা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
সন্তানের পরীক্ষার খাতা পর্যবেক্ষণ করুন—সে কোথায় ভুল করেছে, কীভাবে উন্নতি করতে পারে তা বোঝার চেষ্টা করুন। পরিবারের শিক্ষিত কেউ থাকলে তাঁর সাহায্যে খাতা পর্যালোচনা করুন, প্রয়োজনে শিক্ষকের সঙ্গে পরামর্শ করুন। মনে রাখবেন, শিক্ষক মানুষ—ভুল হতে পারে, তবে তা ধরিয়ে দেওয়ার সময় শত্রুতা নয়, সহযোগিতাই কাম্য।
অভিভাবকের দায়িত্ব ছাত্রের চেয়ে কম নয়। শুধু বেশি নাম্বার পেলেই খুশি হওয়া শিক্ষা নয়। নাম্বারের চেয়ে শেখাটাই বড় বিষয়।
যখন খাতা পর্যালোচনার তারিখ দেওয়া হবে, অবশ্যই উপস্থিত থাকুন এবং সন্তানের ভুল-ত্রুটি ঠিক করার জন্য ঘরে বসেই অনুশীলন করান। যারা সন্তানের জন্য শ্রম দেন, তারাই শেষ পর্যন্ত সফল হন—ইনশাআল্লাহ।
অতএব, বেশি নাম্বার নয়—প্রয়োজন যোগ্যতা, দক্ষতা ও নৈতিকতার শিক্ষা।
শিক্ষকদের সঙ্গে পরিকল্পনা ভাগ করুন, সন্তানের অগ্রগতি ও দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা করুন। একটি প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নির্ভর করে শিক্ষার্থীর উন্নতির উপর। শিক্ষকরা চান প্রতিটি শিক্ষার্থী প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে উঠুক।
প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থান পাওয়া বড় বিষয় নয়। কোথাও ৩৩ পেয়ে কেউ প্রথম হয়, আবার কোথাও ৯৯ পেয়ে হয় না—এটাই বাস্তবতা। নাম্বারের চেয়ে শিক্ষাটাই বড় বিষয়।
কতটা শিখল, কতটা গুণাবলী অর্জন করল, সেটিই আসল মূল্যায়ন।
ভালো পরীক্ষার্থী নয়—আমরা চাই ভালো শিক্ষার্থী।
কারণ, পরীক্ষা কেবল মূল্যায়নের একটি ধাপ, কিন্তু শিক্ষা জীবনের প্রস্তুতি।
যোগ্য শিক্ষক, সচেতন অভিভাবক ও মনোযোগী শিক্ষার্থী—এই তিনের সমন্বয়েই তৈরি হয় প্রকৃত মানুষ।
তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়—
“ভালো রেজাল্ট কার্ডের প্রত্যাশার চেয়ে দক্ষ, যোগ্য ও মানবিক শিক্ষার্থী হওয়াই শ্রেয়।”
লেখক:
এম নজরুল ইসলাম খান
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক, চট্টগ্রাম মডেল স্কুল