এক মাসের বেশি সময় ধরে চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মৃদু থেকে তীব্র দাবদাহ। গত ২ থেকে ১৬ এপ্রিল একটানা ১৫ দিন চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। এপ্রিল মাসের শেষ দিকে তাপমাত্রা কিছুটা কমলেও গত কয়েক দিনে আবার বাড়তে শুরু করেছে। সর্বশেষ গতকাল সোমবার চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। টানা তিন দিন ধরেই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে এই জেলায়।
টানা দাবদাহ, খরা আর অনাবৃষ্টিতে চুয়াডাঙ্গায় শুধু জনজীবনই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েনি, প্রকৃতিও অনেকটাই প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় আম ও লিচুর ফলনে বিপর্যয়ের পাশাপাশি পাট ও আউশ ধানের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বাগানমালিকসহ কৃষকেরা। তবে জেলার কৃষি বিভাগ বলছে, সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় জেলায় পর্যাপ্ত সেচ–সুবিধা আছে। তাই এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের ক্ষতি হবে না।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় বর্তমানে ২ হাজার ৪৬৫ হেক্টর জমিতে আম এবং ৩৩৬ হেক্টর জমিতে লিচুর বাগান আছে। এসব বাগান থেকে চলতি মৌসুমে ২৮ হাজার ২৮৫ মেট্রিক টন আম এবং ৩ হাজার ২৪ মেট্রিক টন লিচু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি মৌসুমে আম ও লিচুর মাধ্যমে অন্তত ১৫০ কোটি টাকার ব্যবসা হওয়ার কথা আছে। তবে অতিরিক্ত গরমের কারণে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে বাগানমালিকেরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
চুয়াডাঙ্গা জেলা আম ও ফল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি কুদ্দুস মহলদার প্রথম আলোকে বলেন, আম ও লিচুর ফলন আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। এবার জেলার বাগানগুলোতে প্রচুর মুকুল ও গুটি ধরেছিল। তবে গরম ও খরার কারণে অনেক বাগানের গুটি ঝরে পড়েছে। কৃষি বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী বাগানে সেচ ও বিভিন্ন ওষুধ স্প্রে করা হলেও তা পুরোপুরি কাজে আসেনি।
পৌর এলাকার কেদারগঞ্জের একটি লিচুবাগানের মালিক আবদুল ওহাব বলেন, খরার কারণে অনেক লিচু অকালে ঝরে যাচ্ছে। গাছে থাকা লিচুও ফেটে যাচ্ছে। এতে আশানুরূপ ফলন হবে না।
মৌসুমি ফলের পাশাপাশি অতিরিক্ত গরম আর অনাবৃষ্টির কারণে আউশ ও পাটচাষিরাও দুশ্চিন্তায় আছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবছর মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৯০ শতাংশের বেশি জমিতে পাটের বীজ বোনা শেষ হয়। তবে চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের গত ৮ মের তথ্য অনুযায়ী, ২০ হাজার ৯২৭ হেক্টর জমির মধ্যে ১৪ হাজার ৪০৩ হেক্টরে বীজ বোনা সম্পন্ন হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৬৯ শতাংশ।
দামুড়হুদার মাদ্রাসাপাড়ার কৃষক আবদুল খালেক বলেন, এ বছর তীব্র খরার কারণে জমি তৈরি থেকে বীজ বুনে চারা গজানোর জন্য উপর্যুপরি সেচ দিতে হচ্ছে। সাধারণত বছরের এই সময় যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়, তাতেই পাটের বীজ বোনার জন্য জমি উপযোগী থাকে। আবার পাট কাটার সময় আসতে আসতে খাল–বিল ও নদীতে পর্যাপ্ত পানি থাকে। এর ফলে পাট জাগ দিতে সমস্যা হয় না। তবে এবার কী পরিস্থিতি হবে, তা বলা যাচ্ছে না। সেচ দিয়ে পাট চাষ করতে হবে, এটা কৃষকের হিসাবের বাইরের ঘটনা। এভাবে খরা চলতে থাকলে অনেকেই পাট চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন।
চুয়াডাঙ্গার বেশির ভাগ জমিতে আউশের বীজতলা তৈরির কাজ শুরু হয়নি। মূলত কৃষকেরা বৃষ্টির অপেক্ষায় আছেন। বৃষ্টি হলেই তাঁরা আউশের বীজতলা তৈরি করবেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এ বছর আউশ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে ৪৬ হাজার হেক্টর জমিতে। এ জন্য বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ হাজার ২৬৫ হেক্টর জমিতে। তবে ৮ মে পর্যন্ত মাত্র ৬৫০ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি সম্পন্ন হয়েছে, যা ২৯ শতাংশেরও কম।
সপ্তাহখানেক ধরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকছে চুয়াডাঙ্গায়। কৃষি কাজ করতে গিয়ে হাঁসফাঁস অবস্থা কৃষকের। গভীর নলকূপের পানি হাত–মুখে দিয়ে কৃষকের স্বস্তি পাওয়ার চেষ্টা। গত রোববার দুপুরে দামুড়হুদা উপজেলার পুড়াপাড়া গ্রামে
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, ‘টানা দাবদাহ ও খরার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তন অন্যতম একটি কারণ। এ কারণে আম ও লিচুর ফলনে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা অমূলক নয়। তবে বৈরী আবহাওয়ার কারণে প্রথম থেকেই আমরা বাগানমালিক ও চাষিদেরকে বাগানে সেচ দেওয়াসহ প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছি। এতে কাজও হয়েছে। অনাবৃষ্টি, খরার কারণে ফলের পাশাপাশি আউশ ও পাট নিয়ে নতুন করে ভাবনা শুরু হয়েছে। তবে জেলায় সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সেচ–সুবিধা থাকায় বড় ধরনের ক্ষতি হবে না। এ ক্ষেত্রে খরচ কিছুটা বাড়বে।’
চুয়াডাঙ্গার হাটকালুগঞ্জে অবস্থিত প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক রাকিবুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ঘুর্ণিঝড়ের প্রভাবের কারণে ১২ মে থেকে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। তবে এর আগপর্যন্ত দাবদাহ চলতে পারে।