বায়তুল্লাহ অভিমুখে হজের সফর একটি বিশুদ্ধ ঈমানি সফর। ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও একনিষ্ঠ আমলের সফর। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্যলাভের সফর। তাই এই সফরে বিভিন্ন করণীয় ও বর্জনীয় বিষয় যেমন রয়েছে, তেমনি বিশেষ স্থানে বিশেষ আমলের অপরিহার্যতা রয়েছে।
এই হজের সফরে হাজির জন্য করণীয় আমলের কথা, সেসবের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলতের কথা যেমন কোরআন-হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তেমনি সে সফরে নিষিদ্ধ ও বর্জনীয় বিষয়ের কথাও কোরআন-হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। ফলে হজে গমনকারী প্রত্যেকের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও আবশ্যকীয় কর্তব্য হলো, এই বর্জনীয় ও নিষিদ্ধ বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত হওয়া ও সর্বপ্রকার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা হজের আলোচনা প্রসঙ্গে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘হজের নির্দিষ্ট কয়েকটি মাস আছে।
যারা এ মাসগুলোতে (ইহরাম বেঁধে) নিজেদের ওপর হজকে অবধারিত করে নেয় তাদের কর্তব্য হলো হজের সময় সব ধরনের অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা। সব গুনাহ ও পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা এবং সব ধরনের ঝগড়া-বিবাদ থেকে মুক্ত থাকা। তোমরা যা কিছু সৎকর্ম করবে আল্লাহ তা জানেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৯৭)
ইসলাম-পূর্ব জাহেলি যুগেও এ ধরনের পাপ সংঘটিত হতো।
তাই আল্লাহ তাআলা হজের বিধান অবতীর্ণকালে এসব পাপ থেকে বেঁচে থাকার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ করেছেন। উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে তিনটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। ১. হজের সফরে কোনো অশ্লীল কথা ও কাজে লিপ্ত হবে না। ২. কোনো গুনাহ ও পাপাচারে লিপ্ত হবে না। ৩. কারো সঙ্গে কোনো ঝগড়া-বিবাদ করবে না।
হজের সফরে মানুষ যখন ইহরাম অবস্থায় থাকে, তখন শয়তান তাদের নানা গুনাহের কুমন্ত্রণা দেয় এবং নানা পাপে লিপ্ত হতে উদ্বুদ্ধ করে। বহু লোকের সফর এবং বহু জায়গায় ভিড় হওয়ার কারণে মানুষ দ্রুত অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে এবং সফর-সঙ্গীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও দুর্ব্যবহার করা, বিভিন্ন স্থানে কর্মরত লোকদের গালাগাল করা, কথায় কথায় গিবত ও সমালোচনা করা অহরহ দেখা যায়। একে অপরকে কষ্ট দেওয়া, পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ, কটুবাক্য ব্যবহার, কারণে-অকারণে উত্তেজিত হওয়া, উত্তেজিত করা নিরেট ইবাদতের এই সফরে অধিকতর প্রকাশ পায়। অথচ এগুলো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও গর্হিত কাজ। ইহরাম অবস্থায় আরো মারাত্মক পাপ। অথচ ইসলামে হজের বিভিন্ন আমল পালন করতে গিয়ে একে অন্যকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে। যেমন ভিড়ের কারণে অন্যকে কষ্ট দেওয়া ছাড়া হাজরে আসওয়াদে চুম্বন করা সম্ভব না হলে দূর থেকে হাত তোলার নিয়ম আছে। অথচ এগুলো শুধু হজের সফরে নয়, গোটা জীবনের বিধান।
ইহরাম অবস্থায় এগুলোর পাপ আরো অধিক। পবিত্র দিনসমূহে এবং পবিত্র স্থানে, যেখানে শুধু আল্লাহর ইবাদতে আগমন করা হয়েছে এবং লাব্বাইকা লাব্বাইকা বলে তালবিয়া পাঠ করা হচ্ছে, ইহরামের সাদা পোশাক তাদের সব সময় এ কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে তোমরা এখন ইবাদতে ব্যস্ত, এ অবস্থায় গালমন্দ করা, ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত অত্যন্ত অন্যায় ও চরম নাফরমানির কাজ। তা ছাড়া তাওয়াফ, সাঈ, আরাফা, মুজদালিফা ও মিনায় বড় জমায়েত হয়। এসব জমায়েতে যতই সতর্কতা অবলম্বন করা হোক স্ত্রী-পুরুষের মেলামেশা হয়েই থাকে। এ অবস্থায় কুদৃষ্টি, পর্দার বিধান লঙ্ঘন, মন্দ বাসনা সৃষ্টি হওয়া থেকে পূর্ণ সংযম অবলম্বন করা জরুরি।
উলামায়ে কেরাম বলেন, সাধারণত যেকোনো নিষিদ্ধ কাজ করা পাপ। কিন্তু পবিত্র মাসে পবিত্র এলাকায় নিষিদ্ধ কাজ করার পাপ অত্যধিক। কারণ আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে আল্লাহর কিতাবে মাসের সংখ্যা ১২টি, সেই দিন থেকে, যেদিন আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে চারটি মাস মর্যাদাপূর্ণ। সুতরাং তোমরা এই মাসসমূহের ব্যাপারে নিজেদের প্রতি জুলুম কোরো না।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ৩৬)
যদি গুনাহমুক্ত হয়ে হজের সফর শেষ করতে পারি, তবেই তা হজে মাবরুর বা মকবুল হজ হিসেবে বিবেচিত হবে, ইনশাআল্লাহ।