প্রকাশকালঃ
১৮ জুলাই ২০২৩ ০৩:৪৮ অপরাহ্ণ ২০০ বার পঠিত
পবিত্র কোরআন অত্যন্ত গুরুত্বের মানবজাতির সামনে পৃথিবীর স্বরূপ তুলে ধরেছে। পৃথিবীর দৃশ্যমান চিত্রের অন্তরালে যে চিত্রগুলো আছে সেগুলো বর্ণনা করেছে। যেন মানুষ পার্থিব জীবনে নিমজ্জিত না থাকে, তারা পৃথিবীর রূপ-সৌন্দর্যে প্রতারিত না হয়, পৃথিবীর মোহে আটকা না পরে; সর্বোপরি পার্থিব জীবনকেই একমাত্র জীবন ভেবে না বসে। কোরআন মানুষকে বারবার সতর্ক করেছে যে পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুকের মতোই।
পৃথিবী হলো শস্যের শুকনা খোসার মতো, যা বৃষ্টির পানি পেলে সজীব হয়; কিন্তু আবারও তা শুকিয়ে যায়। চাকচিক্যময় এই পৃথিবীর স্থায়িত্বও খুব সামান্য। সুতরাং মানুষের উচিত হবে প্রতারক পৃথিবীর মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পরকালীন জীবনের উপার্জন থেকে বিমুখ হয়ে থাকা।
কোরআনের বর্ণনায় পৃথিবীর স্বরূপ
নিম্নে পৃথিবীর স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে এমন কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা হলো।
১. মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে : মানুষ পার্থিব জীবনে নিজেকে স্বাধীন ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মনে করে। অথচ পৃথিবীর কোনো কিছুতেই তার নিয়ন্ত্রণ নেই। নিয়ন্ত্রণ কেবল মহান আল্লাহর। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘বস্তুত পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত এরূপ : যেমন আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করি যদ্দ্বারা ভূমিজ উদ্ভিদ ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে উদ্গত হয়, যা থেকে মানুষ ও জীব-জন্তু আহার করে থাকে।
অতঃপর যখন ভূমি তার শোভা ধারণ করে ও নয়নাভিরাম হয়। তার অধিকারীরা মনে করে তা তাদের আয়ত্তাধীন, তখন দিনে বা রাতে আমার নির্দেশ এসে পড়ে ও আমি তা এমনভাবে নির্মূল করে দিই, যেন গতকালও তার অস্তিত্ব ছিল না। এভাবেই আমি নিদর্শনাবলি বিশদভাবে বিবৃত করি চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত : ২৪)
২. ক্ষণস্থায়ী পৃথিবী : মানুষের পার্থিব জীবন ক্ষণস্থায়ী, যা দ্রুত ফুরিয়ে যায়। বিপরীতে পরকালীন জীবন অনন্ত ও স্থায়ী।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের কাছে পেশ কোরো উপমা পার্থিব জীবনের : তা পানির মতো, যা আমি বর্ষণ করি আকাশ থেকে। যদ্দ্বারা ভূমিজ উদ্ভিদ ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে উদ্গত হয়। অতঃপর তা শুকিয়ে এমন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয় যে বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ সর্ববিষয়ে শক্তিমান।’ (সুরা কাহফ, আয়াত : ৪৫)
৩. ক্রীড়া-কৌতুক মাত্র : স্থায়িত্ব, পরিণাম ও মূল্যের বিবেচনায় পৃথিবী ক্রীড়া-কৌতুক মাত্র, বেলা ফুরানোর পর যার কথা কেউ মনে রাখে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা জেনে রাখো, পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক, জাঁকজমক, পারস্পরিক শ্লাঘা, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কিছু নয়। তার উপমা বৃষ্টি, যদ্দ্বারা উত্পন্ন শস্যসম্ভার কৃষকদের চমত্কৃত করে, অতঃপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তা পীতবর্ণ দেখতে পাও, অবশেষে তা খড়-কুটায় পরিণত হয়। পরকালে রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার সামগ্রী ছাড়া কিছুই নয়।’ (সুরা হাদিদ, আয়াত : ২০)
৪. জীবন-জীবিকা আল্লাহ নির্ধারণ করেন : পৃথিবীতে মানুষের জীবন-জীবিকার সীমারেখা মহান আল্লাহ নির্ধারণ করেন। মানুষ কখনোই সে সীমার বাইরে যেতে পারে না। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা তার জীবনোপকরণ বর্ধিত করেন এবং সংকুচিত করেন। কিন্তু তারা পার্থিব জীবনে উল্লসিত, অথচ দুনিয়ার জীবন আখিরাতের তুলনায় ক্ষণস্থায়ী ভোগ মাত্র।’ (সুরা রা’দ, আয়াত : ২৬)
৫. পার্থিব জীবন পরীক্ষাস্বরূপ : আল্লাহ পার্থিব জীবনকে মুমিনের জন্য পরীক্ষার জায়গা বানিয়েছেন। তিনি তাদের ভোগ-বিলাস, বিপদ ও সম্পদহানির মাধ্যমে পরীক্ষা করে থাকেন। আল্লাহ বলেন, ‘পৃথিবীর ওপর যা কিছু আছে আমি সেগুলোকে তার শোভা করেছি, মানুষকে এ পরীক্ষা করার জন্য যে, তাদের মধ্যে কাজে কে শ্রেষ্ঠ। তার ওপর যা কিছু আছে তা অবশ্যই আমি উদ্ভিদশূন্য ময়দানে পরিণত করব।’ (সুরা কাহফ, আয়াত : ৭-৮)
৬. পার্থিব জীবন প্রতারণা মাত্র : পার্থিব জীবন মানুষকে নানাভাবে প্রতারিত করে। তাই আল্লাহ দুনিয়ার ধোঁকা থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যারা তাদের দ্বিনকে ক্রীড়া-কৌতুকরূপে গ্রহণ করে এবং পার্থিব জীবন যাদেরকে প্রতারিত করে তুমি তাদের সংগ বর্জন কোরো।’ (সুরা আনআম, আয়াত : ৭০)
৭. আপনরাও আপন নয় : পার্থিব জীবনে যাদেরকে মানুষ আপন মনে করে, তারা অনেক ক্ষেত্রেই আপন নয়। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমারে স্ত্রী ও সন্তান-সন্তুতিদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু; অতএব তাদের সম্পর্কে তোমরা সতর্ক থেকো। ...তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি পরীক্ষা বিশেষ; আর আল্লাহ, তাঁর কাছেই আছে মহাপুরস্কার।’ (সুরা তাগাবুন, আয়াত : ১৪-১৫)
মুমিনের করণীয়
কোরআনে পৃথিবীর স্বরূপ বর্ণনা করার পাশাপাশি মুমিনের করণীয়ও তুলে ধরেছে। যেমন—
১. উপেক্ষা করা : আল্লাহ মুমিনদের পার্থিব জীবনের ভোগ-বিলাস ও সৌন্দর্যকে উপেক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি তোমার চোখ দুটি কখনো প্রসারিত কোরো না তার প্রতি যা আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণিকে পার্থিব জীবনের সৌন্দর্যস্বরূপ উপভোগের উপকরণ হিসেবে দিয়েছি, তদ্দ্বারা তাদের পরীক্ষা করার জন্য। তোমার প্রতিপালকের দেওয়া জীবনোপকরণ উত্কৃষ্ট ও অধিক স্থায়ী।’ (সুরা তাহা, আয়াত : ১৩১)
২. পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করা : আল্লাহ পার্থিব জীবনের উপায়-উপকরণকে পরকালের পাথেয় সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ যা তোমাকে দিয়েছেন তদ্দ্বারা আখেরাতের আবাস অনুসন্ধান কোরো এবং দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলো না; তুমি অনুগ্রহ কোরো যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চেয়ো না। আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে ভালোবাসেন না।’ (সুরা কাসাস, আয়াত : ৭৭)
৩. কল্যাণ কামনা করা : মুমিন পার্থিব জীবনে কল্যাণের সঙ্গে জীবনযাপনের দোয়া করবে। কেননা আল্লাহ সেসব মানুষের প্রশংসা করেছেন যারা বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের দুনিয়াতে কল্যাণ দাও এবং আখেরাতে কল্যাণ দাও। আমাদেরকে শাস্তি থেকে রক্ষা কোরো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২০১)
৪. পরকালকে অগ্রাধিকার দেওয়া : মুমিন পার্থিব জীবনে পরকালকে অগ্রাধিকার দেবে। কেননা যারা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দেয় আল্লাহ তাদের নিন্দা করে বলেছেন, ‘কিন্তু তোমরা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দাও, অথচ পরকালই উত্কৃষ্টতর এবং স্থায়ী।’ (সুরা আলা, আয়াত : ১৬-১৭)