বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আলমগীর সরদার ও ফারুক সরদার জীবিকার তাগিদে জীবনের অর্ধেকটা সময় কাটান মালয়েশিয়ায়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সেখান থেকে যা উপার্জন করেন তা দিয়ে সংসারের খরচ মিটিয়ে ৩০ লাখ টাকা জমা করেন। এরই মধ্যে দেশে ফিরে এসে উন্নত জীবনের আশায় ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন দুই ভাই। সে অনুযায়ী তারা নিরব কুমার সরকার ওরফে নিবিড় নামে এক দালালের মাধ্যমে বৈধ পথে ইতালি যাওয়ার জন্য ৩০ লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হন। কিন্তু দালাল নিবিড় ওই টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে গেছেন বলে অভিযোগ। ভুক্তভোগী দুই ভাইয়ের অভিযোগ, তাদের টাকায় দালাল নিজেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
আলমগীর ও ফারুক ফরিদপুরের সালথা উপজেলার মাঝারদিয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আতিকুর রহমান সরদারের ছেলে। অভিযুক্ত দালাল নিবিড় একই মাঝারদিয়া ইউনিয়নের হরিণা গ্রামের মৃত ননী গোপাল সরকারের ছেলে। এদিকে দালালের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা টাকা ফেরত পেতে গ্রামের মাতব্বরদের কাছে ঘুরে কোনো লাভ না হওয়ায় আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।
ভুক্তভোগী ফারুক সরদার অভিযোগ করে বলেন, পেটের দায়ে আমার ৫৩ বছরের জীবনের ২৭ বছর মালয়েশিয়ায় থেকেছি। আমার ভাই আলমগীরও তার ৪১ বছরের জীবনে ১৬ বছর মালয়েশিয়ায় কাটায়। সেখান থেকে আমরা দুই ভাই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করে সংসার চালিয়েছি। পাশাপাশি সারা জীবন কষ্ট করে দুই ভাই মিলে ৩০ লাখ টাকা জমাই। বছরখানেক আগে দেশে ফিরে আসি। বাড়ি আসার পর থেকে পার্শ্ববর্তী হরিণা গ্রামের নিরব কুমার সরকার ওরফে নিবিড় নামে এক দালাল আমাদের ইতালি যাওয়ার পরামর্শ দিতে থাকে। নিবিড় আমাদের পূর্বপরিচিত।
তিনি আরো বলেন, নিবিড়ের মাধ্যমে আমাদের এলাকার একাধিক যুবক বিভিন্ন দেশে গেছে। যে কারণে একপর্যায়ে তার প্রতারণার ফাঁদে পা দিই। পরে আমাদের দুই ভাইকে ইতালি নেওয়ার জন্য নিবিড় সর্বমোট ৩০ লাখ টাকা চায়। ওই টাকায় তিনি আমাদের ইতালি নিয়ে যাবেন বলেন জানান। সেখানে নিয়ে ৯০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি দেওয়ার চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী কয়েক দফায় আমরা দুই ভাই ৩০ লাখ টাকা দিই। এর মধ্যে ২০ লাখ টাকা নিবিড়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়। ব্যাংকের মাধ্যমে যে টাকা পাঠিয়েছি তার জমা রসিদের কাগজ আমাদের কাছে আছে।
কিন্তু টাকা নেওয়ার পর থেকে নিবিড় নানা টালবাহানা শুরু করে। ইতালি নেওয়ার ব্যাপারে আজ-কাল করতে করতে শুধু সময় পার করেন। একপর্যায়ে তিনি নিজেই বিদেশে চলে যায়। পরে বাধ্য হয়ে আমরা দুই ভাই আলাদাভাবে বাদী হয়ে নিবিড় ও তার দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে আদালতে দুটি মামলা করি। মামলা দুটি আদালত আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে সমন জারি করেন। ফারুকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই অভিযোগ করেন তার ভাই আরেক ভুক্তভোগী আলমগীর।
ফারুকের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আতিকুর রহমান সরদার বলেন, ইতালি যাওয়ার জন্য আমার দুই ছেলে নিবিড়কে ৩০ লাখ টাকা দেয়। টাকা নেওয়ার পর থেকে নিবিড়ের আর খোঁজ নেই। আমার ছেলে দুটি নিঃস্ব হয়ে গেছে। ছেলেরা মামলা করার পর থেকে নিবিড় বিদেশে বসে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে আমাদের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যমে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। এ ঘটনায় আমি সালথা থানায় অভিযোগ দিয়েছি।
তিনি আরো বলেন, এখন আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। আমি যেই দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। আজ সেই দেশে আমিসহ আমার পরিবার হুমকিতে আছি। এমন অবস্থায় দালাল নিবিড়ের কাছে থাকা টাকা ফেরত পেতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, দালাল নিবিড়ের মাধ্যমে যারা বিদেশে গেছেন তারা কেউ কাজ পায়নি। সবার সঙ্গেই নিবিড় প্রতারণা করেছেন।
অভিযুক্ত দালাল নিরব কুমার সরকার ওরফে নিবিড় তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে সৌদি থেকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কালের কণ্ঠকে বলেন, আলমগীর আর ফারুকের কাছ থেকে ইতালি নেওয়ার কথা বলে আমি কোনো টাকা-পয়সা নিইনি। আমার সঙ্গে তাদের ব্যাবসায়িক সম্পর্ক। ব্যবসার জন্য ব্যাংকের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে আমার অনেক টাকা লেনদেন হয়েছে। সেই লেনদেনের জমা রসিদ দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আদালত আমাদের বিরুদ্ধে সমন জারি করেছে। আমরা আদালতে গিয়ে আইনের মাধ্যমে মোকাবেলা করব।
তিনি আরো বলেন, মূলত আলমগীর ও ফারুকের আত্মীয় নয়নের সঙ্গে আমার ঝামেলা চলছে। ওই ঝামেলার কারণে আমি নয়নের বিরুদ্ধে মামলা করি। মামলা করার পর ওরা ব্যাংকের লেনদেনের ওই জমা রসিদের কাগজ দিয়ে মামলা করেছে। এ ছাড়া আমি ওদের কাছে ১২ লাখ টাকা পাব। ওই টাকা যাতে না দেওয়া লাগে, এ জন্য ষড়যন্ত্র করছে। আর আমি ভুয়া আইডি খুলে ফেসবুকে কারো বিরুদ্ধে হুমকি-ধমকি বা গালমন্দ করিনি। এটা বানানো গল্প।