জাতীয় পার্টি (জাপা) নিষিদ্ধের দাবির পেছনে শুধু তাদের আওয়ামী লীগের দোসর ভাবার কারণই নেই, রয়েছে ভোটের জটিল সমীকরণও। জামায়াত এ বিষয়টি সরাসরি স্বীকার না করলেও বিএনপি ও জাপার নেতারা এ সমীকরণকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন।
সংস্কার ও নির্বাচনকেন্দ্রিক মতভিন্নতার আড়ালেও আসলে সংসদে দলগুলোর অবস্থান এবং ক্ষমতায় অংশীদার হওয়ার হিসাব কাজ করছে। বিএনপি নেতারা মনে করেন, এসব ইস্যুতে চাপ বাড়ানোর জন্যই জাপা নিষিদ্ধের দাবি সামনে আনা হয়েছে।
রাজনৈতিক সূত্র বলছে, প্রথমে দল ভাঙনের পর এখন জাপাকে দল হিসেবে নিষিদ্ধ করার দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। এমনকি এ দাবি প্রধান উপদেষ্টার কাছেও পৌঁছে গেছে। একই সময়ে বিএনপি জানিয়ে দিয়েছে— তারা কোনো দল নিষিদ্ধের পক্ষে নয়।
জামায়াত আগামী সংসদে প্রধান বিরোধী দল হতে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতায় আসতে চাইছে। জুলাই সনদ ইস্যুতে মতভিন্নতা কমাতে বিএনপি-জামায়াতের বৈঠক হলেও তেমন ফল আসেনি। তবে জামায়াত ছাত্র-তরুণ সংগঠন এনসিপিসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে অভিন্ন অবস্থান নিয়েছে।
বিভিন্ন দলের নেতাদের মতে, জাতীয় পার্টি যদি নির্বাচনে অংশ নেয় এবং আওয়ামী লীগের সমর্থক ভোট পায়, তবে জামায়াতের প্রধান বিরোধী দল হওয়ার সমীকরণ ভেঙে যেতে পারে। এ আশঙ্কা থেকেই জামায়াত ও এনসিপি জাপা নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে। গণঅধিকার পরিষদ এ দাবিতে কর্মসূচি পালনও করেছে, যেখানে সভাপতি নুরুল হক নুর পুলিশি হামলায় গুরুতর আহত হন।
বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল মনে করছে, এভাবে কোনো দল নিষিদ্ধ হলে খারাপ নজির তৈরি হবে। ভবিষ্যতেও এ ধারা চলতে পারে। তাদের মতে, জনগণই কোনো দলের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ করবে ভোটের মাধ্যমে।
অন্যদিকে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. তাহের বলেছেন, জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের দোসর। তাই তাদের বিষয়ে আওয়ামী লীগের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। তবে প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি পালন করেনি জামায়াত।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ভোটের মাঠে জাপার অভিজ্ঞতা ও জনসমর্থন রয়েছে। এ কারণেই প্রতিপক্ষরা দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তুলছে। তিনি আরও বলেন, একটি দলের ভোট আরেক দল পায় না— এমন উদ্ভট আশঙ্কা থেকে কোনো দলকে নিষিদ্ধ করা যায় না। প্রয়োজনে জাপা আইনগতভাবে লড়বে।
বিএনপি স্পষ্ট জানিয়েছে— বহুদলীয় গণতন্ত্রের চেতনায় তারা কোনো দল নিষিদ্ধের পক্ষে নয়। জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। নাগরিক ঐক্য, গণফোরাম ও গণঅধিকার পরিষদের নেতারা অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন সুরে জাপার ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করেছেন।
১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি ৪২.৩% ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসে, আর জামায়াত পায় ৪.৫৪%। এরপর ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে জাপা এককভাবে ৬৮.৪% ভোট পেয়ে আবার সরকার গঠন করে। তবে ১৯৯১ সালের আন্দোলনে এরশাদের পতনের পর তাদের ভোট ক্রমশ কমতে থাকে।
পরবর্তী নির্বাচনে জামায়াত কখনো বিএনপির সঙ্গে জোট করে, কখনো এককভাবে অংশ নিয়েছে। ২০০১ সালে বিএনপি জোটে থেকে ১৭ আসন পায় তারা। জাপা তখন পায় ১৪টি আসন। ২০০৮ সালে জাপা ৭% ভোট পেয়ে ২৭টি আসন পেলেও জামায়াত মাত্র দুটি আসন পায়।
২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে জাপা ৩৪ আসন পায়। তবে ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে তাদের আসন কমতে কমতে দাঁড়ায় যথাক্রমে ২২ ও ১১টিতে।
যদিও ভোটের মাঠে জাপা দুর্বল হয়ে পড়েছে, তবুও আশঙ্কা রয়ে গেছে— আওয়ামী লীগের ভোটের একটি অংশ জাপার বাক্সে পড়লে নির্বাচনের সমীকরণ পাল্টে যেতে পারে। এই ভয় থেকেই জামায়াত জাপা নিষিদ্ধের দাবিকে সামনে আনছে বলে রাজনৈতিক সূত্রগুলো মনে করছে।