ইবাদত-বন্দেগীতে মাইক/লাউড স্পিকার ব্যবহার করা যাবে কিনা?
প্রকাশকালঃ
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০২:৪১ অপরাহ্ণ ১৮৪০ বার পঠিত
লাউড স্পিকার ও মাইক যা বক্তার আওয়াজ বা ধ্বনিকে উচ্চ বা বহু লোকের কাছে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে। এটাকে আরবী ভাষায় مكّبرالصوتঅর্থাৎ আওয়াজকে বুলন্দকারী বলা হয়। যা মূলত পরওয়ারদেগারে আলম রাব্বুল আলামীন ও আহকামুল হাকীমীনের এক নিয়ামত। এভাবে বিদ্যুৎ, বৈদ্যুতিক পাকা, বিমান, গাড়ি, বাল্ব, এসি, ফ্রিজ, মোবাইল ফোন, ইন্টারন্যাট ইত্যাদি যা মানুষের বিজ্ঞানের আবিস্কার, যা মানুষ নিজেদের জীবনমানকে সহজ করার, স্বস্তি ও শান্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে থাকেন। যা আল্লাহর সৃষ্টি ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ খ্যাত মানুষই আবিস্কার করেছেন আল্লাহ্ প্রদত্ত জ্ঞানেই।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন-
অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলা এমন সত্তা যিনি তোমাদের উপকারের জন্য যমীনের সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। [সূরা বাক্বারা: আয়াত-২৯]
অন্য আয়াতে এরশাদ করেন-
অর্থাৎ তোমরা কি দেখ নাই! নিশ্চয় মহান আল্লাহ্ আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে সব কিছুকে তোমাদের জন্য বশীভূত করে দিয়েছেন। তাঁর প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল নেয়ামত তোমাদের উপর পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। [সূরা লোকমান, আয়াত-২০]
রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেছেন-
অর্থাৎ সুতরাং হে জীন ও মানব। তোমরা উভয়ে আপন রবের কোন কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে? [সূরা আর রহমান, আয়াত-১৩]
অর্থাৎ আল্লাহর নেয়ামতসমূহ অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই।
উল্লেখিত আয়াতসমূহ দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে সবগুলোকে রাব্বুল আলামীন তার বান্দাদের কল্যাণের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। অতএব, যতক্ষণ পর্যন্ত কোন বস্তুর ব্যবহারে শরঈ নিষেধাজ্ঞা অবতীর্ণ হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত তা হালাল ও জায়েয হিসেবেই বিবেচিত হবে।
যেমন বিশিষ্ট সাহাবী হযরত সালমান ফারসী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, মহানবী হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
[তিরমিজী-১৭২৬, ইবনে মাজাহـ৩৩৬৭]
অর্থাৎ হালাল ওই বস্তু যা আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় কিতাবে হালাল করেছেন এবং হারাম ওই বস্তু যা আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় কিতাবে হারাম করেছেন এবং যে সম্পর্কে মহান আল্লাহর কিতাবে প্রকাশ্যে ও স্পষ্ট উল্লেখ নেই তা ক্ষমাযোগ্য।
অর্থাৎ যা মুসলমানগণ ভাল হিসেবে গণ্য করেন/ দেখেন, তা মহান আল্লাহ্ তা‘আলার নিকটও উত্তম হিসেবে গণ্য। তদুপরি ক্বোরআন ও হাদীসের দলীল দ্বারা প্রমাণিত ও বাস্তবসম্মত কানুন (বিধান) হল-
অর্থাৎ প্রত্যেক বস্তুর আসল বা মূল বৈধ। অতএব, যতক্ষণ পর্যন্ত কোন বস্তু নিষেধ হওয়ার সুস্পষ্ট কোন দলীল ক্বোরআন-সুন্নাহয় পাওয়া না যায় ততক্ষণ তা বৈধ এবং জায়েয। [কিতাবুল আশবাহ্ ওয়ান্নাযায়ের, কৃত. ইমাম ইবনে নুজাইম হানাফী রহ.]
আর সকল আবিষ্কৃত যন্ত্র তথা মাইক ও লাউড স্পিকার, বিদ্যুৎ, বৈদ্যুতিক পাকা, বিমান, গাড়ি, বাল্ব, এসি, ফ্রিজ, মোবাইল ফোন, ইন্টারন্যাট ইত্যাদি ব্যবহারে কোরআন-হাদীসে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই এবং ভাল ও পুণ্যময় কাজে এ সবের ব্যবহারকে বিশ্বের অধিকাংশ মুফতি ও মুসলমানের সমর্থন রয়েছে। আর বর্তমান মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র জুমা-জামাত ও ইবাদত বন্দেগিতে মাইকের ব্যবহার প্রচলিত। তাই মাইকযোগে কোরআন পাকের তিলাওয়াত, ওয়াজ-নসীহত, দরূদ সালাম এবং মিলাদ ও কিয়াম এবং জুমা-জামাত বৈধ, শরীয়ত সম্মত সর্বোপরি মুসতাহাসান তথা উত্তম সাব্যস্ত। ইবাদত-বন্দেগি ও জুমা জামাতে মাইকের ব্যবহারকে শিরক, গুনাহ্ ও হারাম বলা মূলত জেহালত ও অজ্ঞতারই নামান্তর। তারা মাইক ব্যবহার নাজায়েয ও শিরক বলে পবিত্র কোরআন থেকে যে দলীল পেশ করে থাকে তা তাদের জ্ঞানশূন্যতারই প্রমাণ বহন করে। যেহেতু প্রশ্নে উল্লিখিত আয়াতে মাইক বা লাউড স্পিকার সম্পর্কিত কোন কথার দিকেই ইঙ্গিত/ উল্লেখ নেই, বরং উক্ত আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর আর তার সাথে কোন কিছু শরীক করিওনা।’’ তাই উক্ত আয়াত থেকে ইবাদত বন্দেগিতে মাইকের ব্যবহারকে শিরক ও হারাম বলাটা কোরআনের অপব্যাখ্যা। কারণ কোন মুসলমান মাইককে উপাস্য মনে করে না। এটা একটি আবিষ্কৃত যন্ত্র মাত্র। আর কোরআনের অপব্যাখ্যা কারীর ব্যাপারে শরঈ ফয়সালা হল তার ঠিকানা জাহান্নাম। প্রিয়নবী রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
অর্থাৎ যে পবিত্র ক্বোরআনের মনগড়া (নিজের ইচ্ছামত) ব্যাখ্যা করবে তার উচিত সে যেন জাহান্নামে নিজের ঠিকানা বানিয়ে নেয়। [মিশকাত শরীফ, পৃ. ৩৫]
তবে হ্যাঁ, নামাযের জামাত ছোট হলে তথা মুসল্লি সংখ্যা কম হলে এবং মাইকের ব্যবহার বিশেষ প্রয়োজন না হলে তখন নামাযে মাইকের ব্যবহার হতে বিরত থাকবে। তখন মাইকের ব্যবহার অনর্থক ও অপ্রয়োজন। আর জামাত বড় হলে এবং মুসল্লিদের ইমামের অনুসরণে ব্যাঘাত হলে তখন বড় জামাতে মাইকের ব্যবহার জায়েয ও উত্তম তদ্রুপ আযান, ইকামত, কোরআন তিলাওয়াত, ওয়াজ-নসীহত, হামদ-নাতসহ ভাল ও উত্তম কাজে মাইকের ব্যবহারে কোন অসুবিধা নেই। বরং জায়েয, বিশেষ প্রয়োজনে জুমা ও জামাতে মাইক/সাউন্ড বক্সের ব্যবহার পবিত্র মক্কা-মদিনা, মিশর, আরব আমিরাত, জর্দান, ওমান, লেবানন, বৈরুত, তুরস্ক, ইরান, ইরাক, মালেয়শিয়া, কাতার, বাহারাইন, পাকিস্তান, হিন্দুস্তান ও বাংলাদেশসহ বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ ইসলামী স্কলার ও মুফতিগণ বৈধ বলেছেন।
অবশ্য মাইক ব্যবহার করা হলেও নামাযের অবস্থায় বিদ্যুৎ চলে গেলে কিংবা মাইকে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে মুসল্লিদের ইমামের অনুসরণে অসুবিধার সৃষ্টি না হয়। সর্বোপরি, মাইক বিরোধীদের পক্ষ থেকে মুকাব্বির বানানোর সুন্নাত উঠে যাচ্ছে মর্মে যে আপত্তি উত্থাপন করা হয় তাও দূর হয়ে যায়। উল্লেখ্য যে, যারা ইবাদত-বন্দেগী, জিকির-আযকার,মিলাদ-মাহফিলসহ ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদী ও নামাযের বড় জামাতে মাইক/লাউড স্পিকার ব্যবহারকারীদেরকে মুশরিক ও কাফির ফতোয়া দেয় এবং মাইক ব্যবহারকারীদের আল্লাহর নামে জবেহ কৃত হালাল পশুকে হারাম মনে করে তারা অবশ্যই সীমালঙ্ঘনকারী ও জঘন্যতম অপরাধী। হালালকে হারাম মনে করা কুফুরী এবং ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়। হাদিস শরীফে রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
অর্থাৎ যার জবান (গালি-গালাজ) এবং হাত (প্রহার ও আঘাত থেকে) মুসলিম সমাজ রক্ষায় পায় তিনিই প্রকৃত মুসলমান। [সহীহ্ বুখারী, ১ম খন্ড, ৬ পৃ.]
অর্থাৎ কোন মুসলমানকে গালি-গালাজ করা ফাসেকী আর মুসলমানদের হত্যা করা কুফরী।
[সহীহ বুখারী, ১ম খন্ড, ১২পৃ.]
হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেন-
অর্থাৎ কোন ব্যক্তি যদি কোন মুসলমান ভাইকে কাফের বলে তখন এ কাফের শব্দটি তাদের একজনের দিকে (যাকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে) ফিরবে যদি সে সত্যিই কাফের হয়। আর যদি সে কাফির না হয় তখন কাফের শব্দটি (যে বলেছে) তার দিকে প্রত্যাবর্তন করে। [সহীহ্ মুসলিম শরীফ, ঈমান অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৭]
অবশ্য মাইক ও লাউড স্পিকার ব্যবহার করা ভাল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজে আরব বিশ্বসহ বিশ্বের অধিকাংশ ইমাম, খতিব, মুফতি, মুহাদ্দিস ও ইসলামী স্কলারগণের ফতোয়া মতে জায়েয, হালাল ও উত্তম আর গুনাহের কাজে যেমন- অশ্লীল গান বাজনা ও বেহায়াপনায় মাইক ও লাউড স্পিকারের ব্যবহার হারাম ও গুনাহ্। সুতরাং মাইক বিরোধী ফিরকায়ে মাইকিয়া/আলতাফিয়া/না জায়েজ পার্টি যারা ইবাদত-বন্দেগী, জুমা ও নামাযের বড় জামাত, বয়ান-তকরিরসহ ভালো কাজে মাইক ব্যবহারকে শিরিক ও মাইক ব্যবহারকারীদেরকে মুশরিক ফতোয়া দেয় এবং মাইক যোগে ইবাদতবন্দেগী জায়েয হিসেবে সমর্থনকারীদের হালাল কৃত প্রাণী হারাম বলে ফতোয়াবাজি করে তাদের ঈমান ধ্বংস হয়ে যাবে, তাদের স্ত্রী আকদ/বিবাহ্ হতে খারিজ হয়ে যাবে এবং তাদের জবেহকৃত পশু হারাম হয়ে যাবে। তাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে না বরং তারা নতুন করে খালিস নিয়তে তাওবা পড়ে ঈমান গ্রহণ করে তাদের স্ত্রীর সাথে নতুন করে পুনঃরায় আকদ পড়তে হবে। তাদের সাথে কোন সুন্নি মুসলমান সু-সম্পর্ক রাখতে পারে না। তাদের থেকে অবশ্যই দুরত্ব বজায় রাখতে হবে। কারণ তারা ইবাদত বন্দেগীতে মাইক ব্যবহারকারী বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানকে তাদের ধারণা মতে মুশরিক বিশ্বাস করে। এরা সীমালঙ্ঘনকারী। এ ব্যাপারে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন-
অর্থাৎ তোমাদের কি হয়েছে? যার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়েছে (অর্থাৎ যে হালাল প্রাণীকে আল্লাহর নামে জবেহ করা হয়েছে) তা থেকে তোমরা আহার করছো না। তিনি তো তোমাদের নিকট হারাম কৃত বস্তু বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। তবে তোমাদের নিরুপায় ও একান্ত মজবুরি অবস্থায় ভিন্ন কথা (তখন প্রয়োজন অনুসারে মৃত ও হারাম প্রাণীর মাংস আহার করতে পারবে যতটুকুর দ্বারা প্রাণ রক্ষা হয়) অবশ্য অনেকেই নিজেদের খেয়াল-খুশি ও ইচ্ছানুযায়ী সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে (হালাল বস্তুকে হারাম বলে) মানুষকে পথভ্রষ্ট করে। এরা সীমালঙ্ঘনকারী এদের ব্যাপারে (হে হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-আপনার প্রতিপালক ভালভাবে জানেন। [সূরা আনআম, আয়াত- ১১৯]
এ আয়াতে কারীমায় কুরআন-হাদীস ও ফিক্বহ-ফতোয়ার সঠিক জ্ঞান অর্জন না করে স্বীয় নিছক ধারণা থেকে হালাল ও বৈধ বিষয়কে যারা হারাম ও শিরকের ফতোয়াবাজি করে এসব লোকদেরকে পথভ্রষ্ট ও সীমালঙ্ঘনকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ আয়াতে আরো বলা হয়েছে যে, যারা এসব ভন্ড ও জাহেলদের অনুসরণ করে তাদেরকে এরা নিশ্চয় গুমরাহ্ ও পথভ্রষ্ট করে ছাড়বে।
তবে যারা মাইকের মাধ্যমে ইবাদত-বন্দেগী করাকে শুধু অপছন্দ করে মাত্র; কিন্তু তারা ইবাদত-বন্দেগীতে মাইক ব্যবহারকারীদের জবেহকৃত হালাল প্রাণীকে হারামও মনে করে না। তারা ইসলাম হতে খারিজ হবে না এবং তাদেরকে পথভ্রষ্ট ও সীমালঙ্ঘনকারী বলা যাবে না। এটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। উপরোক্ত বিষয়ে এটাই ইসলামী শরীয়তের ফতোয়া/ফায়সালা।
বি.দ্র. উপরোক্ত ফতোয়াকে সমর্থন করে দস্তখত করেছেন চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাওলানা জসিম উদ্দিন আযহারী, উপাধ্যক্ষ ড. মাওলানা লেয়াকত আলী, প্রধান ফকিহ্ মাওলানা কাযী মুফতি আব্দুল ওয়াজেদ, শাইখুল হাদিস হাফেজ সোলাইমান আনসারী, মুহাদ্দিস হাফেজ আশরাফুজ্জমান আলকাদেরী, ছোবহানিয়া আলিয়ার অধ্যক্ষ মাওলানা হারুনুর রশিদ, উপাধ্যক্ষ মাওলানা জুলফিকার আলী, শাইখুল হাদীস মাওলানা কাজী মঈনুদ্দিন আশরাফী, জামেয়ার মুফাস্সির মাওলানা সালেকুর রহমান আলকাদেরী এবং আল আমিন বারিয়া কামিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুল আজিজ আনোয়ারী প্রমুখ।