অনলাইন ডেস্ক:-
২০২২-২৩ মৌসুমে আলুর উচ্চমূল্য কৃষকদের পরের মৌসুমে (২০২৩-২৪) ব্যাপক হারে আলু চাষে উৎসাহিত করেছিল। এর ফলেই দেশে উৎপাদন বেড়ে নতুন রেকর্ড গড়েছে। সরকারি-বেসরকারি হিসাবে, গত মৌসুমে ১ কোটি ১৫ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়েছে—যা বার্ষিক চাহিদা (৮০ লাখ টন)-এর প্রায় দেড়গুণ। এ কারণেই চলতি মৌসুমে আলুর দাম ধসে পড়েছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা আশঙ্কা করছেন, আগামী মৌসুমে নতুন আলু ওঠার আগেই অতিরিক্ত আলুর বড় অংশ বিক্রি না হয়ে পড়ে থাকবে। অনেকে উৎপাদন খরচ না তুলেই ১০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করেছেন। যারা হিমাগারে বেশি খরচে আলু সংরক্ষণ করেছেন, তারাও এখন ক্ষতির শঙ্কায় ভুগছেন।
রংপুর অঞ্চলে সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে কৃষকরা প্রতি কেজি আলু ১২–১৩ টাকায় বিক্রি করেছেন, যেখানে উৎপাদন খরচ ছিল ১৬–১৭ টাকা এবং সংরক্ষণ খরচসহ মোট খরচ দাঁড়িয়েছে ২৩–২৪ টাকা প্রতি কেজি। কৃষক গোলাম মোস্তফা জানান, তিনি ৭৫০ ব্যাগ আলু হিমাগারে রাখলেও জায়গা সংকটে ৫৫০ ব্যাগ মাত্র ৭ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। গত বছর তিনি ৭০–১৪০ টাকায় আলু বিক্রি করেছিলেন, সেই আশায় এবার ২২ একর জমিতে চাষ করেছিলেন। কিন্তু অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে এবার তার প্রায় আড়াই লাখ টাকার ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
কৃষক কাওসার আলম জানান, কৃষকরা সার ও কীটনাশকের দোকানদারদের পাওনা পরিশোধ করতে পারছেন না। আগামী মৌসুমে অনেকেই আলু চাষ কমাবেন বলে তিনি মনে করেন। তার মতে, সরকার কৃষকদের আর্থিক সহায়তা না করলে হিমাগার মালিকরাও ক্ষতির মুখে পড়বেন।
রংপুর সদরের কিষাণ হিমাগারের ব্যবস্থাপক মাজেদুল ইসলাম বলেন, প্রচুর উৎপাদনের কারণে হিমাগারগুলো পূর্ণ হয়ে গেছে। তারা ১,৫৩,০০০ ব্যাগ আলু মজুদ করলেও অতিরিক্ত ৩০,০০০ ব্যাগ রাখতে পারেননি। তার আশঙ্কা, নতুন মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই আগের মজুদ শেষ নাও হতে পারে।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু জানান, ৩৩৯টি কোল্ড স্টোরেজে রাখা ৩৫ লাখ টনের মধ্যে মাত্র ৮ লাখ টন বিক্রি হয়েছে। সরকারের ঘোষিত ২২ টাকা ন্যূনতম মূল্য কৃষকদের আশার জায়গা তৈরি করলেও, বাস্তবে তা উল্টো প্রভাব ফেলেছে। কৃষকরা উচ্চমূল্যের আশায় মজুদ থেকে আলু তুলছেন না, আর ব্যবসায়ীরা সরাসরি কম দামে কৃষকদের বাড়ি থেকে আলু কিনে নিচ্ছেন। তার মতে, হাজার হাজার কৃষক-ব্যবসায়ী জড়িত থাকায় আলুর দাম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। বরং চাল-আটার পরিবর্তে রেশনিং ব্যবস্থায় আলু অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আসরার চৌধুরী বলেন, আলুর বাজার নির্ভর করে আগের মৌসুমের সিদ্ধান্তের ওপর। গত বছর সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছিল, তাই কৃষকরা এবার জমি বাড়িয়ে চাষ করেছেন। ফলে অতিরিক্ত উৎপাদন হয়ে দাম পড়ে গেছে। তার মতে, এই পরিস্থিতি কৃষকদের নিরুৎসাহিত করবে, ফলে আগামী বছর চাষ কমে গিয়ে দাম আবার বাড়তে পারে। তখন সরকারকে হয়তো আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তিনি যোগ করেন, সরকার প্রায়ই দাম নির্ধারণের চেষ্টা করে উদ্বৃত্ত বা ঘাটতির প্রতিক্রিয়ায় ব্যবস্থা নেয়, কিন্তু বাজারের স্বাভাবিক চাহিদা-সরবরাহের ভারসাম্যই আসল নিয়ামক।