আগামী জুলাই থেকে ব্যাংকঋণের সুদহার কিছুটা বাজারভিত্তিক করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এমনিতে ছয়-নয় সুদহারের কারণে ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি কম। এর সঙ্গে এক বছর ধরে চলছে টাকা দিয়ে ডলার কেনা। অনিয়মের ঘটনা আলোচনায় আসার পর গত নভেম্বর থেকে কয়েকটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক বড় ধরনের তারল্যসংকটে পড়ে। অনেকে এসব ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেন, নতুন আমানত রাখাও কমে যায়। এর জের চলছে এখনো। তাতে পুরো ব্যাংক খাতে তারল্যসংকট না থাকলেও শরিয়াহভিত্তিক ও প্রচলিত ধারার কিছু ব্যাংক এখনো সংকটে রয়েছে।
তারল্যসংকটের কারণে কয়েকটি ব্যাংক ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা হারিয়েছে। এসব ব্যাংকের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে বিশেষ তারল্যসহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী জুলাই থেকে ব্যাংকঋণের সুদহার কিছুটা বাজারভিত্তিক করার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে আমানতের সুদহার বাড়ানোর সুযোগ পাবে ব্যাংকগুলো। তবে এতেও সংকট কাটবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু ব্যাংক থেকে গ্রাহকেরা টাকা তুলে নিয়েছেন, তা ফেরত আসছে না। ঋণের সুদহার বাড়ালেই যে ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরবে, এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আবার করোনার কারণে ব্যবসায়ীরা দুই বছর ঋণ পরিশোধে ছাড় পাওয়ায় ঋণ শোধ করা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। তাতে তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের সমস্যা হলেও এসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উল্টো সহায়তা দিচ্ছে। একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার-সংকটও মোকাবিলা করতে চেয়েছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। ব্যাংক খাতের প্রতি গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে সবার আগে দরকার সুশাসন নিশ্চিত করা। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।
মুস্তফা কে মুজেরী আরও বলেন, সুদহার বাড়ালেই এই সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ, মানুষের হাতে সঞ্চয় করার মতো টাকা কমে গেছে।
কেন সংকট
২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংকঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার কমাতে শুরু করে। কোনো কোনো ব্যাংক তখন আমানতের সুদ ২ শতাংশেও নামিয়ে আনে। পরে আমানতের সুদ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পদক্ষেপ নিলেও সেটি টেকসই হয়নি। কারণ, মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এ কারণে গত বছর আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি দ্বিগুণ হয়ে যায়। সবশেষ গত মার্চ শেষে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ ও ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৩ দশমিক ১২ শতাংশ।
গত বছরের মার্চ থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। এতে দেশে তৈরি হয় ডলার-সংকট, বেড়ে যায় দাম। ডলারের দাম ৮৬ থেকে বেড়ে ১০৮ টাকা হয়ে যায়। এক বছরে ডলারের ২৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির ফলে আমদানি খরচও বেড়ে যায়। সংকট কাটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংকগুলো থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা চলে যায়। কিন্তু ব্যাংকগুলোতে আমানত অতটা বাড়েনি।
গত বছরের নভেম্বরে শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন ঋণ অনিয়মের বিষয়টি সামনে আসে। তাতে এই তিন ব্যাংকে আমানতে টান লাগে। পাশাপাশি ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের আমানত কমে যায়। এসব ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম চলমান রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একাধিক ব্যবস্থা চালু করে।
আমানত কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী গত সপ্তাহে ব্যাংকারদের পক্ষ থেকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গত বছরের শেষ দিকে এসে অনেক আমানতকারী ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেন। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় টাকা ধার করতে হয়েছে।
প্রভাব ও সমাধান কী
গত মার্চে ব্যাংকগুলোর কাছে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। তবে এর মধ্যে বড় অংশ রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের। মূল্যস্ফীতির কারণে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের বাইরে টাকার প্রবাহও ধীরে ধীরে বাড়ছে। গত মার্চ শেষে ব্যাংকব্যবস্থার বাইরে ছিল প্রায় ২ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখা ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্যও ধীরে ধীরে কমে আসছে। মার্চ শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখা বিভিন্ন ব্যাংকের অর্থের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। ২০২২ সালের মার্চে যার পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। তারল্য পরিস্থিতির উন্নতির জন্য ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার ধীরে ধীরে বাড়াচ্ছে। এখন ৮ শতাংশ সুদেও আমানত নিচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংক।
করোনাভাইরাসের পর অনেক উদ্যোক্তা ব্যবসা আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ করলেও এখন তা থমকে আছে। সুদহার কম থাকার প্রভাব বিনিয়োগে নেই বললেই চলে। সরকারের প্রণোদনা তহবিলের ৪-৫ শতাংশ সুদ নিয়ে ব্যবসা চলমান রেখেছেন অনেক ব্যবসায়ী।
এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকের বাইরে টাকার পরিমাণ বাড়ছে। এই অর্থ ব্যাংকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তবে মূল্যস্ফীতি বাড়ায় মানুষের সঞ্চয়ের সক্ষমতা কমে গেছে। আবার ব্যাংক থেকে যে মুনাফা দেওয়া হচ্ছে, তা মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। সব মিলিয়ে তারল্যের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, এখন নতুন কোনো গ্রাহককে ঋণ দেওয়ার সময় নয়। পুরোনো গ্রাহকদেরই ঋণ দিতে অনেক চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে। দেশের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে ঋণ বাড়ানোর বিকল্প নেই। এ জন্য সময়মতো যথাযথ উদ্যোগ প্রয়োজন।