আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
কুড়িগ্রাম জেলার ব্রহ্মপুত্র নদ বেষ্টিত দুর্গম উপজেলা চর রাজিবপুর। এখানকার লক্ষাধিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবার জন্য রয়েছে একমাত্র সরকারি হাসপাতাল রাজিবপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তবে দীর্ঘদিন নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে চলছে হাসপাতালটি।
এখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই, যন্ত্রপাতি অকার্যকর। মেলে না পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ। আট মাস বন্ধ অ্যাম্বুলেন্স সেবা। ফলে এখানে চিকিৎসা নিতে আসা বেশিরভাগ রোগী ক্ষোভ আর হতাশা নিয়ে ফিরে যান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৯৭ সালে চর রাজিবপুর উপজেলার বাসিন্দাদের জন্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি চালু হয়। একপর্যায় ৫০ শয্যায় উন্নীত হয় হাসপাতালটি। এখানে ২৫ জন চিকিৎসকের বিপরীতে রয়েছেন তিনজন চিকিৎসক। এছাড়া জুনিয়র কনসালট্যান্টের ১০টি পদই শূন্য। হাসপাতালটিতে গাইনি, শিশু ও মেডিসিন, নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর চারটি পদ ফাঁকা। তিনজন ওয়ার্ড বয়ের বিপরীতে আছেন একজন, ৩৬টি নার্সের মধ্যে রয়েছেন ১৯ জন। পরিচ্ছন্নতাকর্মী পাঁচজনের মধ্যে আছেন তিনজন। হাসপাতালে তিনজন আয়া থাকার কথা থাকলেও আছেন দুজন।
‘কারেন্ট চলে গেলে এখানে গরমে থাকা যায় না। হাত পাখা ঘুরিয়ে আমাদের থাকতে হয়। ডাক্তারদের চেম্বারে ফ্যান থাকলেও রোগীদের এখানে নেই। দশ বছর মনে হয় টয়লেট পরিষ্কার করে না।
এছাড়াও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চারজন এবং ইউনিয়নে দুজন মিলে মোট ছয়জন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার পদের মধ্যে রয়েছেন চারজন। এসব উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার দিয়ে জরুরি বিভাগের রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে।
হাসপাতালটিতে গত আট মাস অ্যাম্বুলেন্স নেই। জুলাই মাসে জেলার ফুলবাড়ী থেকে আনা পুরোনো একটি অ্যাম্বুলেন্সও পড়ে আছে গ্যারেজে। রোগী পরিবহনের একমাত্র ভরসা ভ্যান বা ভাড়া করা যানবাহন। সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়ায় ঝুঁকিতে পড়ছে অসংখ্য প্রাণ।
‘এখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই, যন্ত্রপাতি অকার্যকর। মেলে না পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ। আট মাস বন্ধ অ্যাম্বুলেন্স সেবা। ফলে এখানে চিকিৎসা নিতে আসা বেশিরভাগ রোগী ক্ষোভ আর হতাশা নিয়ে ফিরে যান।’
এদিকে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ২২ লাখ টাকার বৈদ্যুতিক সোলার কাজে আসছে না। হাসপাতালে বিদ্যুৎ চলে গেলে নেই কোনো বিকল্প ব্যবস্থা। জেনারেটর থাকলেও সেটি চালু করা হয় না। ওয়ার্ডগুলো জরাজীর্ণ, নেই পর্যাপ্ত ফ্যান। যেখানে ফ্যান আছে তার অধিকাংশ নষ্ট, পর্যাপ্ত লাইট নেই। বিদ্যুৎ থাকলেও হাতপাখা ঘোরাতে হয় রোগীদের।
কোথায় জরুরি বিভাগ সেটিও লেখা নেই। জরুরি দুর্ঘটনায় বা অসুস্থ হওয়ার রোগীদের হাসপাতালে প্রবেশ করার পর দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়তে হয় স্বজনদের।
হাসপাতালে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা জানায়, অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় চলে চিকিৎসা সেবা। হাসপাতালে সামনে পিছনে ময়লা আবর্জনায় স্তূপ। সামনে দিকের পরিচ্ছন্নতার অবস্থা আরও ভয়াবহ। টয়লেট থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যন্ত কোথাও নেই নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। দুর্গন্ধ ও আবর্জনায় রোগী ও স্বজনরা পড়েন চরম ভোগান্তিতে।
রোগীদের অভিযোগ, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সরোয়ার জাহান মাসের বেশিরভাগ সময় বিভিন্ন ট্রেনিংয়ের নাম করে বাইরে চেম্বারে সময় দেন।
‘গাড়ি ভাড়া দিয়ে হাসপাতালে এসে যদি আমরা গজ ব্যান্ডেজও না পাই। সব যদি আমাদের কিনতে হয় তাহলে আমরা কেনো হাসপাতালে আসবো। সরকারি হাসপাতালে এসে লাভ কি?’
চর লাঠিয়ালডাঙ্গা গ্রামের তারা মিয়া বলেন, ‘আমি অসুস্থ বাবাকে নিয়ে এসেছি। তারা আমার বাবাকে ময়মনসিংহে রেফার করেছে। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স নেই। জামালপুর থেকে অ্যাম্বুলেন্স আনতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লাগবে। এর মধ্যে কিছু হলে দায় কে নেবে।’
চিকিৎসা নিতে আসা বালিয়াবাড়ি গ্রামের ফরিজল হক বলেন, ‘গাড়ি ভাড়া দিয়ে হাসপাতালে এসে যদি আমরা গজ ব্যান্ডেজও না পাই। সব যদি আমাদের কিনতে হয় তাহলে আমরা কেনো হাসপাতালে আসবো। সরকারি হাসপাতালে এসে লাভ কি?’
চর রাজিপুর মণ্ডলপাড়া গ্রামের আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে এসে আমাকে সমস্ত ওষুধপত্র কিনতে বলেছে। গজ, ব্যান্ডেজ, ইনজেকশন, গ্লোভস, ব্লেড ও ক্যানুলা সবই কিনতে হবে আমাকে।’
উপজেলার মরিচাকান্দি গ্রামের আমেনা খাতুন বলেন, ‘কারেন্ট চলে গেলে এখানে গরমে থাকা যায় না। হাত পাখা ঘুরিয়ে আমাদের থাকতে হয়। ডাক্তারদের চেম্বারে ফ্যান থাকলেও রোগীদের এখানে নেই। দশ বছর ধরে মনে হয় টয়লেট পরিষ্কার করে না। আমি টয়লেটে গিয়ে এ অবস্থা দেখে দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে আসি। মানুষের অসুখ-বিসুখ হলেইতো হাসপাতালে আসে। কিন্তু হাসপাতালে যদি এ অবস্থা হয় তাহলে আমরা যাব কোথায়।’
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সরোয়ার জাহান বলেন, ফুলবাড়ী থেকে যে অ্যাম্বুলেন্সটি আনা হয়েছে সেটি সচল রয়েছে। ওষুধপত্রের ঘাটতি না থাকলেও চিকিৎসক সংকটের কারণে সেবা দিতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছে।
এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. স্বপন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘ভোগান্তি বা সমস্যার বিষয়গুলো আমার জানা নেই। তবে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’