একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিতে ‘অচেনা’ ৫৮টি দলকে নিয়ে ২০১৭ সালের ৭ মে ‘সম্মিলিত জাতীয় জোট’, সংক্ষেপে ‘ইউএনএ’ নামে একটি ‘ঢাউস জোটের’ ঘোষণা দিয়েছিলেন জাতীয় পার্টির (জাপা) তৎকালীন চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। কিছু দিনের মধ্যেই সেই জোট নীরবে হারিয়ে যায়। তবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ফের তৎপর সেই ৫৮ দলের শরিকরা। তারা এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগমুখী। ইতিমধ্যে একাধিকবার বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমুর সঙ্গে। তবে ৫৮ দল তাদের ‘চেয়ারম্যান’ হিসেবে পরিচয় দেন জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদকে।
৫৮ দলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে তারা আওয়ামী লীগের ১৪ দলের সমমনা জোট হিসেবে রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে চান। রওশন এরশাদকে তারা তাদের জোটের চেয়ারম্যান হিসেবে দাবি করেন। তারা জানান, জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাপার একাংশ কোনো কারণে নির্বাচনে অংশ না নিলে, সেক্ষেত্রে রওশনের নেতৃত্বে ৫৮ দল জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন এবং চলমান রাজনীতিতে নিজেদের ভূমিকা নিয়ে সম্মিলিত জাতীয় জোট সর্বশেষ রবিবার আলোচনাসভা করে জাতীয় প্রেসক্লাবে। সভায় বিভাগীয় শহরে মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দেন ইউএনএর নেতারা। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বলেছেন, ‘সেই সমাবেশ (মহাসমাবেশ) প্রমাণ করবে—৫৮ দলই যথেষ্ট ঐ বিএনপিকে মোকাবিলা করার জন্য, ঐ জামায়াতকে মোকাবিলা করার জন্য। ৫৮ দলভুক্ত যে আটটি ইসলামি দল রয়েছে, তারা ঐক্যবদ্ধভাবে ঐ জামায়াতকেও মোকাবিলা করতে পারবে।’
এর আগে গত ২৭ জুলাই আমির হোসেন আমুর সঙ্গে তার নিউ ইস্কাটনের বাসায় বৈঠক করেন ৫৮ দলের নেতারা। ঐ বৈঠকের আলোচ্য ছিল, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং চলমান রাজনীতিতে দল ও জোটসমূহের ভূমিকা ও করণীয়’। সম্মিলিত জাতীয় জোটের পক্ষে এর মহাসচিব খন্দকার মো. ইমদাদুল হকের নেতৃত্বে ঐদিন বৈঠকে যোগ দেওয়া ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদলটি আমির হোসেন আমুকে জানিয়েছিল, তাদের চেয়ারম্যান রওশন। বৈঠকে তাদেরকে আলাদা জোট হিসেবে তৎপরতা চালানোর পরামর্শ দেন ১৪ দলের সমন্বয়ক। একই সঙ্গে সম্মিলিত জাতীয় জোটের কোনো কর্মসূচিতে ডাকলে অংশ নেবেন বলেও সেদিন তাদেরকে আশ্বাস দেন আমির হোসেন আমু।
সেদিন বৈঠকে অন্যদের মধ্যে ছিলেন সম্মিলিত জাতীয় জোটের মুখপাত্র আলতাফ হোসাইন মোল্লা, জোটের প্রধান সমন্বয়কারী শাহ ওয়ালিউল্লাহ ফরহাদ, ডেমোক্রেটিক পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান, জাতীয় জনতা পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান, জাতীয় ওলামা মাশায়েখ পার্টির চেয়ারম্যান শরিফ হাজারী, বাংলাদেশ ইসলামিক জনতা পার্টির চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলাম, গ্রামীণ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হায়দার আলী, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পার্টির চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেহ্? মো. ফিরোজ মল্লিক, ইসলামিক সমাজতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান তালিবুল ইসলাম প্রমুখ।
জানা গেছে, সম্মিলিত জাতীয় জোটের নেতারা বছরখানেক আগে যোগাযোগ করতে থাকেন বর্তমানে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের ‘মুখপাত্র’ কাজী মামুনুর রশিদের সঙ্গে। ২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর কাউন্সিলের মাধ্যমে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে জি এম কাদের জাপার নেতৃত্বে আসার পর দলটি থেকে ছিটকে পড়েন একসময়ের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী মামুন। এরপর কাজী মামুন ‘তৃণমূল জাতীয় পার্টির ব্যানারে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশাকে সঙ্গে নিয়ে। মামুন ছিলেন এর মহাসচিব। সম্মিলিত জাতীয় জোটের নেতারা তখন রাজধানীর বারিধারায় প্রয়াত এরশাদের বাসা ‘প্রেসিডেন্ট পার্ক’-এ বিদিশা ও মামুনের সঙ্গে প্রায়ই বৈঠক করতেন। নানা কারণে বিদিশার সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হলে কাজী মামুন ভিড়ে যান রওশনের সঙ্গে। সাম্প্রতিক সময়ে রওশনকে কেন্দ্র করে জাপায় যে পৃথক বলয় তৈরি হয়, সেটিরও মূল অর্থায়নে ও সংগঠিত করার ভূমিকায় ছিলেন কাজী মামুন। জানা গেছে, রওশনের নেতৃত্বে সম্মিলিত জাতীয় জোট গঠনের মূল ভূমিকায়ও তিনি।
এদিকে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে মেডিক্যাল চেকআপ শেষে গতকাল মঙ্গলবার দেশে ফিরেছেন রওশন এরশাদ। চার দিন আগে ব্যাংকক যাওয়া কাজী মামুনও রওশনের সঙ্গে ফিরেছেন। কাজী মামুন ইত্তেফাককে বলেন, ‘৫৮ দলের নেতারা ম্যাডামকে (রওশন) তাদের চেয়ারম্যান হিসেবে মান্য করেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে পরামর্শক্রমেই ৫৮ দলের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। রওশন এরশাদ আগের তুলনায় বেশ সুস্থ। তিনি এখন রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন, সম্মিলিত জাতীয় জোটেরও নেতৃত্ব দেবেন।’
এ বিষয়ে রওশন এরশাদের সঙ্গে কথা বলতে গতকাল রাতে ইত্তেফাকের পক্ষ থেকে টেলিফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, গত ১৯ জুলাই গণভবনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ১৪ দলের সভায় ১৪ দল সম্প্রসারণ না করার বিষয়ে আলোচনা হয়। সভায় বলা হয়, ১৪ দল একটি আদর্শিক জোট, এই জোটে নতুন করে আর কাউকে শরিক করা হবে না। তবে কয়েকটি ইসলামি দলসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলোকে নিয়ে সমমনা পৃথক জোট গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এরশাদ যখন এই জোট গঠন করেন, তখন তাতে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত দল ‘ইসলামিক ফ্রন্ট’ ছিল। তবে, ২৭ জুলাই আমির হোসেন আমুর সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া ৫৮ দলের সম্মিলিত জাতীয় জোটে ইসলামিক ফ্রন্ট ছিল না। অন্য দলগুলোর কারো নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন নেই। এসব দলের মধ্যে রয়েছে প্রতিবাদী জনতা পার্টি, আমজনতা পার্টি, জনতা ফ্রন্ট, ইসলামি মূল্যবোধ সংরক্ষণ পার্টি, খেদমতে খালক পার্টি, সচেতন হিন্দু পার্টি ইত্যাদি। ইসলামপন্থী দলের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ খেলাফত সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ ইসলামিক জনকল্যাণ পার্টি, জাতীয় শরিয়া আন্দোলন, হেফাজতে মুসলেমিন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফাতুল উম্মাহ, বাংলাদেশ আকিমুদ্বীন মজলিশ প্রমুখ।