সাড়ে ২৩ কোটি ডলার চীনা ঋণে কেনা হচ্ছে চার জাহাজ

প্রকাশকালঃ ২৭ আগu ২০২৩ ০৪:৫০ অপরাহ্ণ ২৬৪ বার পঠিত
সাড়ে ২৩ কোটি ডলার চীনা ঋণে কেনা হচ্ছে চার জাহাজ

জাহাজ কেনার জন্য সাড়ে ২৩ কোটি ডলারের সরবরাহকারী ঋণ দিচ্ছে চীন। এই ঋণ পরিশোধের সময় ১৫ বছর। এর মধ্যে চার বছর গ্রেস পিরিয়ড। সব মিলিয়ে সুদের হার ২ দশমিক ২ শতাংশ। প্রাথমিক পরিকল্পনায় ছয়টি জাহাজ কেনার কথা ছিল। কিন্তু ডলার এবং জাহাজ নির্মাণের সরঞ্জামের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন সেই দামে মিলবে চারটি।

চীন থেকে নতুন ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। এই ঋণের অর্থে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) জন্য চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ কেনা হবে। প্রাথমিক পরিকল্পনায় ছয়টি জাহাজ কেনার কথা ছিল। কিন্তু ডলার এবং জাহাজ নির্মাণের সরঞ্জামের দাম বেড়ে যাওয়ায় নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তাই এখন সেই দামে মিলবে চারটি জাহাজ। আড়াই বছরের দর-কষাকষির পর চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে জাহাজের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ।

এসব জাহাজ কেনার জন্য সাড়ে ২৩ কোটি ডলারের সরবরাহকারী ঋণ দিচ্ছে চীন। সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে এই বাণিজ্যিক ঋণচুক্তি হতে পারে। বাণিজ্যিক ঋণচুক্তির পরপরই চীনা কোম্পানি চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন বা সিএমসিকে জাহাজ নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হবে। এই কোম্পানি দর-কষাকষির পর্যায়ে জাহাজের নকশা, পরিমাপসহ যাবতীয় বিষয় ঠিক করেছে।


অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে ডলার–সংকটের এই সময়ে সরকারিভাবে জাহাজ কেনার উদ্যোগ থেকে সরে আসার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদেরা।

বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ছয়টি জাহাজ কিনতে হলে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন এবং এর জন্য নতুন করে আলোচনা চালাতে হতো। বাকি দুটি জাহাজ আলাদা প্রকল্পের মাধ্যমে চীনা ঋণে কেনা হবে।


২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে চীনের সঙ্গে এই ঋণ নিয়ে আলোচনা শুরু করে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন। তখন ৮০ হাজার ডিডব্লিউটি সক্ষমতার তিনটি মাদার বাল্ক জাহাজ ও ১ লাখ ১৪ হাজার ডিডব্লিউটি সক্ষমতার তিনটি ক্রুড অয়েল মাদার ট্যাংকার কেনার কথা ছিল। পরে আড়াই বছর ধরে এ নিয়ে দর-কষাকষি চলে। কিন্তু এর মধ্য ডলারের দাম বেড়েছে, জাহাজ নির্মাণের লোহাসহ সব জিনিসের দাম বেড়েছে—এসব কারণ দেখিয়ে চীনা কর্তৃপক্ষ ছয়টি জাহাজ দিতে পারবে না বলে জানায়। বাংলাদেশ তাতেই রাজি হয়। এখন সেভাবেই বাণিজ্যিক চুক্তি হবে।

ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে গত দেড় বছরে ডলারের দাম প্রায় ২৫ শতাংশের মতো বেড়েছে। এই সময়ে প্রতি ডলারের দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১০৯ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে স্ক্র্যাপসহ বিভিন্ন ধরনের ইস্পাতের দাম দ্বিগুণ হয়েছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরবরাহকারী ঋণে ঋণদাতারা প্রথমে বেশি পণ্যের কথা বলে, পরে দর-কষাকষির চূড়ান্ত পর্যায়ে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে পণ্যের সংখ্যা কমিয়ে দেয়। এটি পুরোনো কৌশল। দর-কষাকষির নানা পর্যায়ে এ দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের “সন্তুষ্ট” করার অভিযোগও আছে। এ ছাড়া ডলার–সংকটের এ সময়ে বিদেশি মুদ্রায় জাহাজ কেনার প্রয়োজন নেই। দিলে ছয়টি জাহাজ, না হয় চুক্তি বাতিল করা উচিত।’


প্রকল্পে যা আছে
চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রায় আড়াই বছর দর-কষাকষির পর গত ২৮ ডিসেম্বর প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। গত এপ্রিল মাসে ২ হাজার ৬২০ কোটি টাকার প্রকল্প পাস হয়। এর মধ্যে চীন সরকারের ঋণ ২ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। ১৬৭ কোটি ৬৫ লাখ আরএমবির সমপরিমাণ চীনা মুদ্রায় ঋণ দেওয়া হবে। চীন সরকার তাদের এক্সিম ব্যাংক থেকে এই তহবিল নিয়ে বাংলাদেশকে দেবে। জানা গেছে, এই ঋণ পরিশোধের সময় ১৫ বছর। এর মধ্যে চার বছর গ্রেস পিরিয়ড। সব মিলিয়ে সুদের হার ২ দশমিক ২ শতাংশ।

বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন বলেন, আগে ছয়টি জাহাজ কেনার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ডলারের পাশাপাশি জাহাজ বানানোর জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় চারটি জাহাজ দেবে চীনা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান।

মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন আরও বলেন, ‘দর-কষাকষির শুরুতে যে পরিমাণ ঋণ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম, তা বাড়াতে হলে আবার নতুন করে আলোচনা করতে হতো। তাই ঋণের অঙ্ক অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। বাকি দুটি জাহাজ আলাদা আরেকটি প্রকল্পের মাধ্যমে চীনা ঋণে কেনা হবে।’


জাহাজের দাম বেড়েছে ৫০%
প্রকল্পের কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, বর্তমানে একটি মাদার বাল্ক জাহাজের দাম পড়ছে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭৮০ কোটি টাকা। প্রথম যখন দর-কষাকষি শুরু হয়েছিল, তখন একই জাহাজের দাম ধরা হয়েছিল ৫২০ কোটি টাকা। অন্যদিকে ক্রুড অয়েল মাদার ট্যাংকারের দাম পড়ছে ৪৬২ কোটি ডলার। আগে এর দাম ছিল ৩০৮ কোটি ডলার। এখন এ ধরনের জাহাজ কিনতে অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ দাম দিতে হচ্ছে।

দর-কষাকষির প্রতিটি পর্যায়ে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন প্রতিনিধিরা ছিলেন। এই কোম্পানির প্রতিনিধিরা আগের দামে জাহাজ দিতে না পারার কথা জানিয়েছেন। কারণ, ডলার ও বিভিন্ন সরঞ্জামের মূল্যবৃদ্ধি। চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন জাহাজগুলোর নকশা ও পরিমাপসহ সবকিছু করেছে।

চীনা ঋণের বিপরীতে দরপত্র আহ্বান করা হয় না। এটি সরবরাহ ঋণ, তাই বাণিজ্যিক ঋণচুক্তি হওয়ার পর সরাসরি চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনকে জাহাজ বানানোর কার্যাদেশ দেওয়া হবে। ২০২৬ সালের মধ্যে জাহাজ চারটি বানিয়ে বাংলাদেশকে হস্তান্তর করা হবে।

জাহাজ কেনার বিষয়ে প্রশ্ন তুলে আহসান এইচ মনসুর বলেন, জাহাজের ভাড়া আগের তুলনায় ১০ ভাগের ১ ভাগে নেমে এসেছে। নতুন করে জাহাজ কেনার প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া দেশে বেসরকারি খাতের ৯৩টি সমুদ্রগামী জাহাজ আছে। সেখানে সরকারি খাতে চারটি জাহাজ যুক্ত করলে তেমন কিছু হেরফের হবে না।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রেল, সড়কসহ বর্তমানে চীনা ঋণে ১৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। সব মিলিয়ে ঋণের পরিমাণ ১ হাজার কোটি ডলারের বেশি।


চীনা ঋণে যত অসুবিধা
চীনা ঋণের অসুবিধা হলো এটি পুরোটাই সরবরাহকারী ঋণ। চীনা কর্তৃপক্ষই ঠিকাদার ঠিক করে দেয়। আবার ঋণ দর-কষাকষির পর্যায়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই দাম-দর চূড়ান্ত করে থাকে। এতে কাজের মান ও দর নিয়ে অনেক সময় প্রশ্ন ওঠে। দরপত্রের মাধ্যমে একাধিক দরদাতার দর দেখার সুযোগ নেই।

ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, গত ডিসেম্বর মাসে সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে (এলটিএম) রাজি হয়েছে চীন। তবে এতে শুধু চীনা ঠিকাদারেরা অংশ নেবেন।

এ ছাড়া চীনা ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমাও বেশ কম। গ্রেস পিরিয়ড বাদ দিলে ১০-১৫ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হয়। এতে প্রতিটি কিস্তিতে অর্থের পরিমাণ বেশি হয়, যা সার্বিক ঋণ পরিশোধে চাপ সৃষ্টি করে।

চীনা ঋণের সুবিধা হলো ঋণের সুদের হার স্থির থাকে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) অন্য দাতা সংস্থার কাছ থেকে নেওয়া ঋণের হার এসওএফআর অনুযায়ী ওঠানামা করবে।