কোরআনের বর্ণনায় শ্রেষ্ঠত্ব লাভের শক্তি

প্রকাশকালঃ ২০ মার্চ ২০২৩ ০৪:১৮ অপরাহ্ণ ৩৪০ বার পঠিত
কোরআনের বর্ণনায় শ্রেষ্ঠত্ব লাভের শক্তি

দার্শনিকরা জ্ঞান ও অনুভূতির পাঁচটি উপায় বর্ণনা করেছেন। এগুলোকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় বলা হয়। তা হচ্ছে শ্রবণ, দর্শন, ঘ্রাণ, আস্বাদন ও স্পর্শ। এগুলো জ্ঞান, চেতনা ও অনুভূতি লাভের মাধ্যম। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি বলুন, তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং কান, চোখ ও অন্তর দিয়েছেন। তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ (সুরা মুলক, আয়াত : ২৩)

উল্লিখিত আয়াতে মানুষের অঙ্গগুলোর মধ্যে তিনটি অঙ্গের কথা উল্লিখ করা হয়েছে। কেননা এগুলোর ওপর জ্ঞান, অনুভূতি ও চেতনা নির্ভরশীল। ঘ্রাণ, আস্বাদন ও স্পর্শের মাধ্যমে তুলনামূলক কম জ্ঞান মানুষ অর্জন করতে পারে। বেশির ভাগ মানুষের জ্ঞান শ্রবণ ও দর্শনের মধ্যে সীমিত। এর মধ্যে শ্রবণকে আগে আনা হয়েছে। চিন্তা করলে দেখা যায়, মানুষের সারা জীবনের অর্জিত জ্ঞানের মধ্যে শোনা বিষয়ের সংখ্যা, দেখা বিষয়ের তুলনায় অনেক বেশি। তাফসিরবিদরা বলেছেন, মানুষের বেশির ভাগ জ্ঞান এই দুই মাধ্যমে অর্জিত হয়। তাই আয়াতে এই দুটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর অন্তর হলো জ্ঞানার্জনের আসল ভিত্তি ও কেন্দ্র। আর শ্রবণ ও দর্শনের জ্ঞানও অন্তরের ওপর নির্ভরশীল। এখানেই তৈরি হয় ‘দ্য পাওয়ার অব এক্সিলেন্স’ বা শ্রেষ্ঠত্বের শক্তি। বিপরীতে দার্শনিকরা মস্তিষ্ককে জ্ঞানের কেন্দ্র মনে করেন। মানুষ যত বেশি জ্ঞান ও অনুভূতিকে কাজে লাগায় তত বেশি সে শাণিত হয়। তার মধ্যে তত বেশি ‘পাওয়ার অব এক্সিল্যান্স’ পরিপক্ব হয়।

মহান আল্লাহ মানুষকে অসংখ্য নিয়ামত দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা যদি আল্লাহর নিয়ামত গণনা করো তাহলে গুনে শেষ করতে পারবে না।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত : ৩৪)

কিন্তু মানুষ এসব মূল্যবান নিয়ামত খুবই কম মূূল্যায়ন করে। যারা নিয়ামতের প্রতি যত্নবান হয় তারা লাভবান হয় এবং শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়। এ ক্ষেত্রে মুসলিম ও অমুসলিম সবাই সমান। আল্লাহ সবাইকে সুযোগ দিয়ে পরীক্ষা করেন। তিনি দেখেন, তার অফুরন্ত নিয়ামত ভোগ করে কে তার সন্ধান পায়, কে পথ হারায়। এ জন্য কোরআনে নিয়ামতের বর্ণনার পাশাপাশি প্রতি মানুষের অবমূল্যায়ন ও অকৃতজ্ঞতার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তিনি সবার পরিশ্রমের মূল্যায়ন করেন এবং এর পুরস্কার দেন। এটাই তার অমোঘ বিধান। ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষ যতটুকু চেষ্টা করবে ততটুকু ফল পাবে।’ (সুরা নাজম, আয়াত : ৩৯)

আধুনিককালে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে জ্ঞান-গবেষণায় দৃষ্টান্ত ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ স্টিফেন উইলিয়াম হকিং। তিনি প্রমাণ করেছেন, সুস্থ মানুষের মতো হাত-পা ছাড়াও শুধু অনুভূতিনির্ভর জ্ঞান দিয়ে বিশ্ব জয় করা যায়। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার অবিরাম প্রচেষ্টার মধ্যে ঈমানদ্বীপ্ত অন্তরের জন্য বিশেষ খোরাক রয়েছে।

ইসলামের ইতিহাসেও কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের অনন্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। যুগে যুগে শত বাধা ও প্রতিবন্ধকতা জয় করে সম্মান ও মর্যাদার উচ্চাসনে বসেছেন। যেমন অন্ধ সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.), যাকে কেন্দ্র করে কোরআনের একটি আয়াত নাজিল হয়েছে, পারস্য দরবার কাঁপানো খোঁড়া সাহাবি রিবয়ি ইবনে আমির (রা.), প্রখ্যাত বধির তাবেঈন মুহাম্মাদ ইবনে সিরিন (রহ.), হাদিসগ্রন্থ তিরমিজির অন্ধ লেখক ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ঈসা (রহ.), উমাইয়া যুগের বিখ্যাত বধির কবি কুমাইত ইবনে জায়েদ আসাদি, আব্বাসি যুগের কবিসম্রাট (অন্ধ) বাশশার ইবনে বুরদ, আরবি সাহিত্যের প্রখ্যাত অন্ধ কবি আবুল আলা মাআররি এবং আধুনিক যুগের ইসলামী সাহিত্যিক ও গবেষক (বধির) মোস্তফা সাদেক রাফেয়ি। এমন আরো বহু দৃষ্টান্ত আছে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন না। কিন্তু জীবনযুদ্ধে তারা হার মানেননি। এসব সমস্যাকে আল্লাহর ইচ্ছা হিসেবে মেনে নিয়ে কর্মযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছেন। অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ইতিহাসের পাতায় এমন কীর্তি স্থাপন করেছেন, যা সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ করতে পারেনি। আবু দারদা (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘আল্লাহ যখন কারো ক্ষেত্রে কোনো ফায়সালা করেন তিনি চান সে যেন তার ফায়সালায় সন্তুষ্ট হয়। যে আল্লাহকে পেল তার হারানোর কিছুই থাকে না।’

কোনো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে ধৈর্য ধারণ করা মুমিনের কর্তব্য। ধৈর্য ধারণকারীদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে। আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘আপনি সুসংবাদ দিন ধৈর্যশীলদের, যারা বিপদে আক্রান্ত হলে বলে আমরা তো আল্লাহর এবং নিশ্চিতভাবে তার কাছেই প্রত্যাবর্তন করব। তারা হলো সেসব ব্যক্তি, যাদের ওপর তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষিত হয়, তারাই সৎপথে পরিচালিত।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৫৫-১৫৭)

তাই হীনম্মন্যতায় না ভুগে চিকিৎসার পাশাপাশি আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করা এবং নিজের সবটুকু দিয়ে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়া উচিত। আর সুস্থ ও সবলদের উচিত, আল্লাহর অফুরন্ত নিয়ামতের মূল্যায়ন করা এবং শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে নিজেদের নিমগ্ন রাখা। আধুনিক যুগে যোগ্যরাই শ্রেষ্ঠ। সমাজে টিকে থাকতে হলে যোগ্যতার প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হতে হবে। যারা ইসলাম ও মানবতার কল্যাণে স্রষ্টা প্রদত্ত মেধা ও বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের স্বাক্ষর রাখবে, তাদের ইহকাল ও পরকালে রয়েছে বিশেষ সম্মাননা।