সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ-এম.নজরুল ইসলাম খান 

  প্রিন্ট করুন   প্রকাশকালঃ ২৫ আগu ২০২৫ ০৪:১২ অপরাহ্ণ   |   ১৪২ বার পঠিত
সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ-এম.নজরুল ইসলাম খান 

বার্তাকক্ষ (চট্টগ্রাম):-


সত্য,বস্তুনিষ্ঠ ও নৈতিক- মানবিক সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালন বড় চ্যালেঞ্জ।

ইসরাইল কর্তৃক গাজায় সাংবাদিক হত্যা চলছে, কয়েকদিন আগে আল জাজিরার কয়েকজন সাংবাদিক গাজায় হত্যা হয়েছে। বাংলাদেশে জুলাই গণঅভ্যুত্থান বা গণ আন্দোলনে কমপক্ষে পাঁচ জন সাংবাদিক হত্যা হয়। সম্প্রতিক গাজীপুরে দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ'র সাংবাদিক মোঃ আসাদুজ্জামান তুহিন নৃশংসভাবে খুন হন।জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক  বিভু রঞ্জন সরকারের লাশ মেঘনা নদীতে পাওয়া যায় ২৩ আগস্ট ২০২৫। সাংবাদিক, মিডিয়াকর্মীর উপর বা বিভিন্ন মিডিয়ার উপর আক্রমণ,দখল, মামলা, ভয়-ভীতি সহিংসতা সব সময়ই  দেখে আসছি। সার্কুলেশন বাতিল, নিবন্ধন বাতিল করা,তালা দেয়া, পেশাগত দায়িত্ব পালনে ব্যাহত হয় এমন আইন পাস করা, আইন করা, এক্রিডিটেশন বাতিল সহ বিভিন্নভাবে সাংবাদিকদের ওপর তার পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা ও চ্যালেঞ্জ আসছে। তাই আজকের আমার কিছু কথা যা এ সব পরিস্থিতিতে সাংবাদিক ও নেতৃবৃন্দের করণীয় বিষয় আমার মত দিলাম।

সাংবাদিকতা সমাজের আয়না। এটি শুধু তথ্য পরিবেশনের মাধ্যম নয়, বরং সত্য অনুসন্ধান, অন্যায়ের প্রতিবাদ এবং গণতন্ত্র রক্ষার অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট এবং সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তনের ফলে সাংবাদিকতা আজ অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তবে একইসাথে নতুন সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে, যা সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎকে নতুন দিগন্তে নিয়ে যেতে পারে।

সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জঃ
১. রাজনৈতিক চাপ ও মতপ্রকাশের সংকট:
অনেক দেশে সাংবাদিকরা সরকারের বিরোধিতা করলে হয়রানি, হামলা কিংবা আইনি জটিলতার মুখোমুখি হন। কখনো সংবাদ পরিবেশনে সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়, আবার কখনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে। গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে এই চ্যালেঞ্জ সবচেয়ে বড় বাধা।

২. অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা:
প্রিন্ট মিডিয়ার জনপ্রিয়তা কমছে এবং বিজ্ঞাপন আয় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাচ্ছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পাঠক সংখ্যা বাড়লেও সেখানেও টেকসই আয় নিশ্চিত নয়। অনেক মিডিয়া প্রতিষ্ঠান আর্থিক সংকটে পড়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা মানসম্মত সাংবাদিকতা ধরে রাখতে পারছে না।

৩. ভুয়া খবর ও বিভ্রান্তি বা ভিউ ব্যবসা:
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মিথ্যা তথ্য বা ভুয়া খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষ অনেক সময় যাচাই না করেই এগুলো বিশ্বাস করে। এতে সাংবাদিকতার বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ হয় এবং সত্য সংবাদও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

৪. সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ঝুঁকি:
রাজনৈতিক আন্দোলন বা সংঘাতময় এলাকায় কাজ করা সাংবাদিকদের জন্য জীবনহানির ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। অনেক সাংবাদিক হামলা, অপহরণ এমনকি হত্যার শিকার হয়েছেন। এতে নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকরা ভীত ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছেন।

৫. নৈতিক সংকট ও হলুদ সাংবাদিকতা:
কখনো কখনো সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেল অতিরঞ্জিত, পক্ষপাতদুষ্ট বা বিনোদনমূলক খবরকে অগ্রাধিকার দেয়। কর্পোরেট বা রাজনৈতিক স্বার্থে প্রভাবিত হয়ে সাংবাদিকরা নৈতিক মানদণ্ড উপেক্ষা করেন। এর ফলে পাঠক বা দর্শকের আস্থা কমে যাচ্ছে।অনেক রাজনৈতিক নেতা মিডিয়ার মালিক হয়ে সাংবাদিকদের তাদের কর্মীর মত ব্যবহার করছেন বা কিছু সাংবাদিক রাজনৈতিক কর্মী।

৬. প্রযুক্তির চাপ:
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), রোবোটিক নিউজ জেনারেশন, ডিপফেক ইত্যাদি প্রযুক্তি সাংবাদিকতার পদ্ধতি বদলে দিচ্ছে। প্রযুক্তি যেমন সুযোগ সৃষ্টি করছে, তেমনি ভুল তথ্য বা বিভ্রান্তি তৈরি করেও সাংবাদিকতার সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে।

সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাঃ

১. ডিজিটাল সাংবাদিকতার প্রসার:
ভবিষ্যৎ সাংবাদিকতা মূলত ডিজিটালভিত্তিক হবে। অনলাইন নিউজ পোর্টাল, সোশ্যাল মিডিয়া, মোবাইল সাংবাদিকতা, ইউটিউব চ্যানেল ও পডকাস্ট নতুন প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দ্রুত সংবাদ পরিবেশন ও সহজলভ্যতার কারণে ডিজিটাল সাংবাদিকতা ভবিষ্যতের প্রধান মাধ্যম হবে।

২. অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও ডেটা জার্নালিজম:
গভীর বিশ্লেষণ ও তথ্যভিত্তিক সংবাদ পরিবেশনা ভবিষ্যতের সাংবাদিকতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ডেটা বিশ্লেষণ, পরিসংখ্যান ও গ্রাফিক্স ব্যবহার করে সংবাদ পরিবেশন আরও আকর্ষণীয় ও গ্রহণযোগ্য হবে। এতে পাঠকের আস্থা বাড়বে।

৩. নাগরিক সাংবাদিকতার উত্থান:
সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সাধারণ মানুষও এখন সংবাদ পরিবেশন করছে। দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা স্থানীয় ঘটনার ছবি ও ভিডিও তারা তাৎক্ষণিকভাবে শেয়ার করছে। ভবিষ্যতে মূলধারার সাংবাদিকতা ও নাগরিক সাংবাদিকতার সমন্বয় আরও শক্তিশালী হবে।

৪. নৈতিক সাংবাদিকতার গুরুত্ব:
কোন কোন ক্ষেত্রে অনৈতিক এবং দুর্নীতিপরায়ণ কিছু লোক এ পেশাকে কুলুষিত করেছে তার প্রমাণও আমরা ইতিমধ্যেই পেতে পেয়েছি এটা সাংবাদিকতা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ যে স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সাংবাদিকতা পেশাকে রাজনৈতিক দুর্নীতি এবং ব্যক্তি স্বার্থ বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় সমৃদ্ধ হবে 
ভবিষ্যতে বস্তুনিষ্ঠতা ও নৈতিকতা সাংবাদিকতার মূল মাপকাঠি হয়ে উঠবে। পাঠক-দর্শক আস্থা ফিরে পেতে হলে সাংবাদিকদের সত্যনিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতা অটলভাবে মেনে চলতে হবে।

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, সহিংসতা, ভয়-ভীতি, হত্যা, নির্যাতন  এসকল মামলার প্রায় ৮৭% অমীমাংসিত। তাই সাংবাদিকের সাংবাদিকতা পেশাকে আরো সমৃদ্ধশালী করতে হলে এবং বাংলাদেশকে সু্ন্দর,স্বচ্ছ,দুর্নীতিমুক্ত,জবাবদিহি করতে হলে সাংবাদিকতাকে আরো নিরাপদ পরিবেশ,প্রশিক্ষণ ও সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে এ পেশাকে সমৃদ্ধ করতে হবে। 

সাংবাদিকতা কখনো সহজ ছিল না, ভবিষ্যতেও হবে না। প্রতিটি যুগেই সাংবাদিকদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। তবে প্রযুক্তি, নৈতিকতা ও সাহসী মনোভাবের সমন্বয়ে সাংবাদিকতা ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। গণমাধ্যমের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের সত্য জানা ও বোঝার অধিকার রক্ষা করা। যা সত্য তাই তথ্য।