সময় জীবনের অমূল্য সম্পদ। মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। এর যথার্থ ব্যবহারের মধ্যে সাফল্য নিহিত। আল্লাহ মানুষকে অগণিত নিয়ামতের মধ্যে সময় সবচেয়ে দামি।
তাই পবিত্র কোরআনে রাত-দিন ও চাঁদ-সূর্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি তোমাদের কল্যাণে সূর্য ও চাঁদকে নিয়োজিত করেছেন, যা অবিরাম একই নিয়মের অনুসারী, তোমাদের কল্যাণে রাত ও দিনকে নিয়োজিত করেছেন। তিনি তোমাদের দিয়েছেন তোমরা যা তার কাছে চেয়েছ, তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা করলে তা নির্ণয় করতে পারবে না, মানুষ খবুই জালিম ও অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত : ৩৩-৩৪)
সময়ের গুরুত্ব উপলব্ধি : মানুষ সময়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করে না। কাজকর্মে নিষ্ক্রিয় ও অলস হয়ে পড়ে। সুস্থ ও অবসরের সময়ের ব্যাপারে উদাসীন থাকে। ফলে অসুস্থ বা ব্যস্ত হয়ে পড়লে তার কাছে সময়ের প্রকৃত মূল্য উপলব্ধি হয়। হাদিসের ভাষ্যমতে, খুবই অল্প সংখ্যক মানুষ এই দুই সময়ের সদ্ব্যবহার করতে পারে।
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, দুটি নিয়ামত এমন রয়েছে যে ব্যাপারে অধিকাংশ লোক প্রতারিত হয়। তা হলো- সুস্থতা ও অবসর সময়।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪১২)
সময়ের ব্যাপারে ছাড় নয় : ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেছেন, ‘সময়ের ব্যাপারে ছাড়ের প্রবণতা আত্মঘাতি। কারণ সময় অতি দ্রুত অতিবাহিত হয়। কারো জন্য অপেক্ষা করে না।
আর ফিরে আসে না। সব শ্রেণির কাছে সময় সবচেয়ে সম্মানিত বস্তু। ইবাদতকারী নির্ধারিত সময়ে ইবাদত ও জিকিরে কাটিয়ে থাকেন। আল্লাহমুখী কাজে সময় ব্যয় করেন। তাই নির্ধারিত সময় চলে গেলে তা ফিরে পাওয়া অসম্ভব। কারণ পরবর্তী সময়েরও নির্ধারিত কাজ রয়েছে। কেউ সময় অতিবাহিত করলে তা আর ফিরে পায় না।’ (মাদারিজুস সালিকিন, পৃষ্ঠা : ৪৯)
আপেক্ষ করে কালক্ষেপন নয় : হারিয়ে যাওয়া সময়ের জন্য আক্ষেপ করে কালক্ষেপন করা অনুচিত। এতে বর্তমান সময়ও নষ্ট হয়। বরং নতুন করে এখন থেকেই পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু করা কর্তব্য। তাই বলা হয়, ‘আল ওয়াকতু কাস সাইফি, ইন লাম তাকতাহু কাতাআক।’ ‘সময় তরবারির মতো। তুমি তাকে হত্যা না করলে সে তোমাকে হত্যা করবে।’ অর্থাৎ সময়কে কাজের মাধ্যমে ব্যয় না করলে সে তোমাকে অনর্থক কাজে ব্যস্ত করে রাখবে। (বাহজাতুন নুফুস, পৃষ্ঠা : ৯৬)
ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেছেন, ‘আমি সুফিদের সান্নিধ্যে ছিলাম। তাদের থেকে আমি দুটি কথা ছাড়া কিছুই শিখিনি। তাদের একটি কথা হলো, সময় হলো তরবারি। তুমি তাকে না কাটলে সে তোমাকে কেটে ফেলবে। আরেকটি কথা হলো, তুমি নিজেকে সত্যের কাজে ব্যস্ত না রাখলে তুমি মিথ্যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। (আল-জাওয়াবুল কাফি, পৃষ্ঠা : ২০৮)
সময়ের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ : মানুষের সময় হলো তার জীবন। তা আল্লাহর নির্দেশনা মতে কাটানোর মধ্যে প্রকৃত সাফল্য। সালাফে সালেহিন সময়কে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে ব্যয় করতেন। বিখ্যাত সাহাবি আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) বলেছেন, ‘আমি ওই দিন বেশি লজ্জিত হই যেদিন সূর্য উদিত হয়েছে এবং আমার নির্ধারিত সময় কমেছে। কিন্তু আমার আমল বৃদ্ধি পায়নি।’ উমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.) বলেছেন, ‘রাত ও দিন তোমার সামনে কাজ করে যাচ্ছে। অতএব তুমিও তাদের মধ্যে কাজ কোরো।’
হাসান বসরি (রহ.) বলেছেন, ‘হে আদম সন্তান, তুমি তো দিনের সমষ্টি। একদিন চলে যাওয়ার অর্থ তোমার কিছু চলে যাওয়।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘আমি এমন একদল লোক পেয়েছি, যারা সময়ের প্রতি এত বেশি গুরুত্ব দিতেন, যা দিরহাম ও দিনারের প্রতি তোমাদের আগ্রহের চেয়ে বেশি ছিল।’ (কিমাতুজ জামান, পৃষ্ঠা : ২৭)
মুমূর্ষু অবস্থায় আলোচনা : ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মজলিসে ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) দীর্ঘ ১৭ বছর বসেছিলেন। আবু ইউসুফ (রহ.) সময়ের প্রতি এত বেশি সচেতন ছিলেন যে এই দীর্ঘ সময়ে তিনি কখনো অসুস্থতা ছাড়া শিক্ষকের মজলিসে বসা বাদ দেননি। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) তিনজন আব্বাসি খলিফার সময়ে প্রধান বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তাঁর ছাত্রদের নিয়ে বিভিন্ন সময় ফিকহি আলোচনা করতেন। এমনকি মৃত্যু শয্যায়ও তিনি আলোচনা করেছিলেন। জীবনের অন্তিম মুহূর্তে তিনি তাঁর ছাত্র কাজি ইবরাহিম বিন আল-জাররাহ-এর সঙ্গে বিভিন্ন মাসআলা নিয়ে কথা বলেন। মুহাম্মদ বিন কুদামা (রহ.) বর্ণনা করেছেন, ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)-এর এক সন্তান মারা যায়। তিনি সন্তানের কাফন ও দাফন কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেননি। যেন আবু হানিফা (রহ.)-এর কোনো দরস হারিয়ে না যায়। তাঁর আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশিরা তার সন্তানকে দাফন করে। (মানাকিবু আবি হানিফা, পৃষ্ঠা : ৪৭২)
রাত জেগে ইলমচর্চায় সময় ব্যয় : ইমাম মুহাম্মদ বিন আল-হাসান আল-শাইবানি (রহ.) ছিলেন ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর আরেক ছাত্র। ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) ইলমচর্চায় অত্যন্ত নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। সময়ের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতেন তিনি। বর্ণিত আছে, তিনিও সব সময় ইলম চর্চায় ব্যস্ত থাকতেন। এমনকি রাতেও ঘুমাতেন না। সারারাত কিতাব পড়ে পার করতেন। এক বিষয়ে পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়লে অন্য বিষয় পড়া শুরু করতেন। আর পানি ছিটিয়ে ঘুম তাড়াতেন। তিনি বলতেন, উষ্ণতা থেকে ঘুম আসে। তাই পানি দিয়ে তা তাড়াতে হয়। (মিফতাহুস সাআদাহ, পৃষ্ঠা : ২৩)
অল্প সময়ে অসংখ্য গ্রন্থ রচনা : শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) মাত্র ৫৭ বছর বেঁচেছিলেন। এ সময়ে তিনি প্রায় পাঁচ শ গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগাতেন। পড়া বা লেখা বা ইবাদত ছাড়া কোনো মুহূর্ত ব্যয় কাটাতেন না। আল্লামা আবদুল হাই লখনৌবি (রহ.) মাত্র ৩৯ বছর বেঁচেছিলেন। এ সময়ে তিনি ১১০টির বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে অনেক গ্রন্থ কয়েক খণ্ডের রয়েছে। হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলি থানবি (রহ.) ৮১ বছর বেঁচেছিলেন। এ সময়ে হাজারের বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। মূলত কঠোর সময়ানুবর্তিতার কারণে তাঁদের পক্ষে এত বেশি লেখা সম্ভব হয়েছে।
মহান আল্লাহ আমাদের সময়ের সঠিক ব্যবহারের তাওফিক দান করুন।