শিশুর লালন-পালন ও অধিকার সুরক্ষায় ইসলাম সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। শিশুর সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে শরিয়তে বিশদ বিবরণ রয়েছে। সন্তান লালন-পালনে মায়ের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। তাই কোরআনে সন্তানের জন্য মায়ের কষ্টের বিবরণ বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি মানুষকে তার বাবা ও মায়ের সঙ্গে সদাচারের নির্দেশ দিয়েছি, তার মা কষ্ট করে তাকে গর্ভ ধারণ করেছে এবং কষ্ট করে প্রসব করেছে...।’ (সুরা : আহকাফ, আয়াত : ১৫)
খালা মায়ের মতো : মায়ের অবর্তমানে সন্তান লালন-পালনে মায়ের দিকের আত্মীয়রা বাবার দিকের আত্মীয়ের চেয়ে অগ্রাধিকার পাবে। তবে এটি শুধু লালন-পালনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে; উত্তরাধিকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। তাই সন্তানের ফুফুর চেয়ে খালাই অগ্রাধিকার পাবে। কেননা খালার আচার-ব্যবহারে সন্তান মায়ের হারিয়ে যাওয়া আদর, স্নেহ ও মমতাবোধ লাভ করে। হাদিসে খালাকে মায়ের মতো উল্লেখ করা হয়েছে। আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, খালা মায়ের সমমর্যাদায়। (আবু দাউদ, হাদিস : ২২৭৪)
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেছেন, হাদিসটি সন্তান লালন-পালনের অধিকার বিষয়ে এসেছে। ইমাম জাহাবি (রহ.) এই হাদিসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, সন্তান লালন-পালনে খালা মায়ের সমমর্যাদায় থাকবেন। তাই মায়ের মতো খালার প্রতিও সদাচার করা ও আত্মীয়তার সুসম্পর্ক রাখা কর্তব্য। (ফাতহুল বারি : ৭/৫০৬)
মায়ের অনুপস্থিতিতে খালার অধিকার : সন্তানের মায়ের দিকের আত্মীয়দের অগ্রাধিকার পাওয়ার বিষয়টি হাদিসে বিশদভাবে এসেছে। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর রাসুল (সা.) সাহাবিদের নিয়ে মদিনা থেকে মক্কায় গিয়ে ওমরাহ পালন করেন। তিন দিন পর মক্কা থেকে বের হওয়ার সময় হামজা বিন আবদুল মুত্তালিবের (রা.) মেয়ে উমামা (অথবা উমারা) (রা.) রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে মদিনায় যেতে চান। তাঁর মা সালমা বিনতে উমাইস ও বাবা হামজা। তখন তাঁকে নেওয়ার জন্য আলী (রা.), জাফর (রা.) ও জায়েদ (রা.)-এর মধ্যে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। সবাই নিজ অধিকারের ব্যাপারে যুক্তি পেশ করতে থাকে। তখন রাসুল (সা.) তাঁর চাচাতো ভাই জাফর (রা.)-এর পক্ষে রায় দিয়ে বলেন, খালা মায়ের সমমর্যাদায়। কেননা জাফর (রা.)-এর স্ত্রী ছিলেন আসমা বিনতে উমাইস (রা.); যিনি হামজা (রা.)-এর মেয়ের খালা ছিলেন।
একটি দীর্ঘ হাদিসে বারাআ বিন আজিব (রা.) বর্ণনা করেছেন, ... নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হওয়ার পর মক্কার মুশরিকরা এসে আলী (রা.)-কে বলল, মেয়াদ শেষ হয়েছে। এখন আপনার সঙ্গীকে আমাদের এখান থেকে চলে যেতে বলুন। রাসুল (সা.) বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় হামজার মেয়ে তাদের পিছু নিয়ে বলল, হে চাচা, হে চাচা। (কারণ হামজা (রা.) রাসল (সা.)-এর চাচা ও দুধ ভাই ছিলেন)। তখন আলী বিন আবু তালিব (রা.) তার হাত ধরেন এবং ফাতেমা (রা.)-কে বলেন, তোমার চাচাতো বোনকে নাও। ফাতেমা (রা.) তাকে কোলে তুলে নেন। আলী (রা.) ছাড়াও তাকে নেওয়ার জন্য জায়েদ (রা.) ও জাফর (রা.) তর্ক শুরু করেন। আলী (রা.) বলেন, আমি তাকে নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশি অগ্রাধিকার পাই। কারণ সে আমার চাচাতো বোন। আর জাফর (রা.) বলেন, সে আমার চাচাতো বোন এবং তার খালা আমার স্ত্রী। জায়েদ (রা.) বলেন, সে আমার ভাইয়ের মেয়ে। অতঃপর রাসুল (সা.) মেয়েটির খালার পক্ষে রায় দেন এবং বলেন, ‘খালা মায়ের সমমর্যাদায়।’ আর আলী (রা.)-কে উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তুমি আমার অন্তর্ভূক্ত এবং আমি তোমার অন্তর্ভূক্ত।’ এরপর জাফর (রা.)-কে বলেন, ‘স্বভাব-চরিত্র ও সৃষ্টিগত দিক থেকে আপনি আমার মতো।’ আর জায়েদ (রা.)-কে বলেন, ‘তুমি আমাদের ভাই ও মুক্ত করা দাস।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস ২৬৯৯)
খালার সেবা করার নির্দেশ : হাদিসে মায়ের অনুপস্থিতিতে খালার সেবা করার নির্দেশনা রয়েছে। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.)-এর কাছে এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমি একটি কবিরা গুনাহ করে ফেলেছি। আমার কি তাওবা করার সুযোগ আছে? তিনি প্রশ্ন করেন, তোমার মা কি বেঁচে আছেন? সে বলল, না। তিনি আবার প্রশ্ন করেন, তোমার খালা কি আছেন? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বলেন, ‘তাঁর সঙ্গে উত্তম আচরণ করো।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৯০৪)
এই হাদিসে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়। তা হলো, মহান আল্লাহ মায়ের সেবা করলে মানুষের পাপ ক্ষমা করেন। আর মা না থাকলে খালার সেবা করার মাধ্যমে এই মর্যাদা লাভ করা যায়।