ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার ফল দেরিতে প্রকাশে সমস্যা

প্রকাশকালঃ ১৩ মার্চ ২০২৪ ১১:২৯ পূর্বাহ্ণ ১৮৫ বার পঠিত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার ফল দেরিতে প্রকাশে সমস্যা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ ও ইনস্টিটিউটগুলোতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের বিভিন্ন পরীক্ষার ফল নিয়ম অনুযায়ী যথাসময়ে প্রকাশ করা হয় না। চূড়ান্ত পরীক্ষার ফল সেমিস্টার পদ্ধতিতে ছয় সপ্তাহ আর কোর্স পদ্ধতিতে আট সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশের নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। এতে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে।


দেরিতে ফল প্রকাশে নানা বিপত্তি

শিক্ষকরা বলছেন, অনেক সময় কিছু খাতা তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে যায় এবং কিছু পরীক্ষক বেশি খাতা দেখেন। তাই ফল প্রকাশে দেরি হয়। শিক্ষার্থীরা বলছেন, ফল প্রকাশে দেরি হওয়ায় চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। তা ছাড়া উচ্চশিক্ষা নিতে দেশের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রেও বড় বাধা এটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাসংক্রান্ত নিয়মাবলির মধ্যে রয়েছে, তাত্ত্বিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর কোর্স পদ্ধতিতে আট সপ্তাহের মধ্যে এবং সেমিস্টার পদ্ধতিতে ছয় সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে হবে।


গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯টি অনুষদের ৭১টি বিভাগে ও ১০টি ইনস্টিটিউটে মোট ৫৮৪টি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে মাত্র ৩৭টি পরীক্ষার ফল যথাসময়ে প্রকাশিত হয়েছে। বাকি ৫৪৭ পরীক্ষার ফল দেরিতে প্রকাশিত হয়েছে। বিভাগ ও ইনস্টিটিউট ভেদে গড়ে ফল প্রকাশে দেরির সময় ৬ থেকে ১৬ সপ্তাহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিস থেকে প্রাপ্ত নথি বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া যায়।


নথির তথ্য অনুযায়ী, কলা অনুষদের বিভাগগুলোতে অনুষ্ঠিত সেমিস্টার পদ্ধতির ১৭২টি পরীক্ষার মধ্যে চারটি পরীক্ষার ফল যথাসময়ে প্রকাশিত হয়েছে।  অনুষদটিতে ইংরেজি ও নৃত্যকলা বিভাগ গড়ে ৯ সপ্তাহের বেশি, আরবি এবং বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগ গড়ে আট সপ্তাহের বেশি দেরি করে ফল প্রকাশ করেছে। বাকি বিভাগগুলো গড়ে দুই থেকে সাত সপ্তাহের বেশি দেরি করেছে। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগগুলোতে অনুষ্ঠিত সেমিস্টার পদ্ধতির ১৪৯টি পরীক্ষার মধ্যে একটি পরীক্ষার ফল যথাসময়ে প্রকাশিত হয়েছে।


অনুষদটিতে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ গড়ে ১৩ সপ্তাহের বেশি, কমিউনিকেশন ডিস-অর্ডারস গড়ে ১০ সপ্তাহের বেশি দেরি করে ফল প্রকাশ করেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ গড়ে ৯ সপ্তাহের বেশি দেরি করেছে। বাকি বিভাগগুলো গড়ে দুই থেকে ছয় সপ্তাহের বেশি দেরি করেছে। আইন অনুষদের আইন বিভাগে অনুষ্ঠিত পাঁচটি কোর্স পদ্ধতির পরীক্ষার ফল কোনোটিই যথাসময়ে প্রকাশিত হয়নি। আইন বিভাগ গড়ে ১৬ সপ্তাহের বেশি দেরি করে ফল প্রকাশ করেছে।


বিজ্ঞান অনুষদে সাতটি বিভাগে অনুষ্ঠিত ২৪টি কোর্স পদ্ধতি পরীক্ষার ফল কোনোটিই যথাসময়ে প্রকাশিত হয়নি। অনুষদটিতে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ গড়ে সাত সপ্তাহের বেশি, পরিসংখ্যান বিভাগ ছয় সপ্তাহের বেশি এবং বাকি বিভাগগুলো ফল প্রকাশে গড়ে চার থেকে ছয় সপ্তাহ দেরি করেছে। ফার্মেসি অনুষদে তিনটি বিভাগে অনুষ্ঠিত কোর্স পদ্ধতির সাতটি পরীক্ষার মধ্যে একটি পরীক্ষার ফল যথাসময়ে প্রকাশিত হয়েছে। অনুষদটিতে ফার্মেসি বিভাগ গড়ে সাত সপ্তাহের বেশি দেরি করে ফলাফল প্রকাশ করেছে।


আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের বিভাগগুলোতে অনুষ্ঠিত কোর্স পদ্ধতির ৯টি ও সেমিস্টার পদ্ধতির ১৮টি পরীক্ষার মধ্যে একটি পরীক্ষার ফল যথাসময়ে প্রকাশিত হয়েছে। অনুষদটিতে সমুদ্রবিজ্ঞান গড়ে আট সপ্তাহের বেশি, ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স গড়ে সাত সপ্তাহের বেশি এবং ভূতত্ত্ব বিভাগ গড়ে সাত সপ্তাহ দেরি করে ফলাফল প্রকাশ করেছে।


ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের বিভাগগুলোতে অনুষ্ঠিত সেমিস্টার পদ্ধতির ৪৪টি পরীক্ষার মধ্যে একটি পরীক্ষার ফল যথাসময়ে প্রকাশিত হয়েছে। অনুষদটিতে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ গড়ে ১০ সপ্তাহ, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল এবং রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ গড়ে সাত সপ্তাহের বেশি দেরি করে ফল প্রকাশ করেছে।


চারুকলা অনুষদের বিভাগগুলোতে অনুষ্ঠিত কোর্স পদ্ধতির ৪৪টি পরীক্ষার মধ্যে ১৭টি পরীক্ষার ফল যথাসময়ে প্রকাশিত হয়েছে। অনুষদটিতে শিল্পকলার ইতিহাস গড়ে সাত সপ্তাহের বেশি দেরি করে ফল প্রকাশ করেছে। জীববিজ্ঞান অনুষদে ৯টি বিভাগে অনুষ্ঠিত কোর্স পদ্ধতির ৪০টি পরীক্ষার মধ্যে চারটি পরীক্ষার ফলাফল যথাসময়ে প্রকাশিত হয়েছে। অনুষদটিতে প্রাণিবিদ্যা বিভাগ গড়ে ১০ সপ্তাহ, উদ্ভিদবিজ্ঞান ৯ সপ্তাহের বেশি দেরি করে ফলাফল প্রকাশ করেছে।


১০টি ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত ১৭টি কোর্স পদ্ধতি ও ৫৫টি সেমিস্টার পদ্ধতির পরীক্ষায় যথাসময়ে আটটি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ গড়ে ১৪ সপ্তাহ, স্বাস্থ্য অর্থনীতি গড়ে আট সপ্তাহের বেশি, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট এবং পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে ছয় সপ্তাহের বেশি দেরি করে ফল প্রকাশ করেছে।


দেরিতে ফল প্রকাশ নিয়ে জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী নেওয়াজ শরীফ আরমান বলেন, ‘ফল দেখলে বুঝতে পারি কোন জায়গাগুলোতে ঘাটতি ছিল এবং কোথায় উন্নতি করতে হবে। পাশাপাশি কোনো কোর্সে রেজাল্ট ভালো না হলে ইমপ্রুভমেন্টের প্রস্তুতিও নিতে পারি। শেষ মুহূর্তে রেজাল্ট পেলে ইমপ্রুভমেন্ট দেওয়ার সুযোগ থাকে না। এতে সামগ্রিক ফলাফলের ওপর প্রভাব পড়ে এবং মানসিকভাবে পীড়ন দেয়।’


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরবি বিভাগের মাস্টার্সের এক শিক্ষার্থী বলেন, ফল দেরিতে প্রকাশিত হলে বেশি সমস্যা হয় বিভিন্ন চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে। বেশির ভাগ চাকরিতেই ফল প্রকাশের পর আবেদন করতে হয়। তা ছাড়া দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার একটা বড় বাধা  দেরিতে এই ফল প্রকাশ।


বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আব্দুস সামাদ বলেন, ‘অনেক সময় কিছু খাতা তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে যায় আবার পরীক্ষকরা বেশি খাতা দেখেন বলে খাতা জমা দিতে দেরি হয়ে যায়। তাই ফল প্রকাশে দেরি হয়। তবে আমরা জুলাই থেকে নতুন নীতিমালায় যাচ্ছি। এতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফল প্রকাশ করা সম্ভব হবে।’


কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির বলেন, ‘কলা অনুষদের ক্ষেত্রে সাত কলেজের সাতটি বিভাগের খাতাও শিক্ষকদের দেখতে হয়। তখন তাদের ওপর চাপ হয়ে যায়। তাই একটু বিলম্ব হয়। তবে শিক্ষকদের দিক থেকেও গাফিলতি একটু আছে। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় এখন খাতা দেখার বিষয়ে নতুন বিধান করছে। খাতা দেখার সংখ্যা বাড়ানো হবে। এতে যথাসময়ে ফল প্রকাশিত হবে।’


বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য সব অনুষদভুক্ত বিভাগ ও ইনস্টিটিউট পরীক্ষাসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত (পরীক্ষা শুরু, শেষ ও ফলাফলের তারিখ) পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসে দিলেও ব্যবসা শিক্ষা অনুষদ ও ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউট কোনো তথ্যই দেয় না।


এ বিষয়ে ব্যবসা শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুল মঈন বলেন, ‘অনেক আগে থেকে আমরা একটি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এসেছি। চতুর্থ বর্ষে চূড়ান্ত পরীক্ষার পর আমরা ফল সমন্বিত করে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বরাবর পাঠাই। এখন বিশ্ববিদ্যালয় নতুন একটি নিয়মের মধ্যে যাচ্ছে। আমরাও ধীরে ধীরে এর মধ্যে চলে যাব।’


এ বিষয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. বাহালুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের সেকশনে বিভাগ/ইনস্টিটিউট থেকে ফল পাঠানো হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে তা প্রকাশ করি। ফল দেরিতে হওয়ার পেছনে আমাদের দপ্তরের কোনো কারণ নেই। শিক্ষকরা যখনই আমাদের ফল পাঠান, আমরা তা দ্রুত সময়ে প্রকাশ করি।’


সার্বিক বিষয়ে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা শিক্ষকরা যথাসময়ে ফলাফল দেবেন। ফল প্রকাশে দেরির বিষয়ে আমি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ডিন, চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলব। আমরা একটি সফটওয়্যারের ব্যবস্থা করছি, যেখানে একাডেমিক কার্যক্রম নিয়মিত মনিটর করা হবে। তখন ফল প্রকাশের নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গেলে বিলম্বের বিষয়টি বোঝা যাবে।


ডিনদের সঙ্গে এর মধ্যে বসা হয়েছে। ফলাফল দ্রুত প্রকাশ করতে খাতা বেশি হলে দুজন পরীক্ষকদের মধ্যে খাতা ভাগ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। খাতার সংখ্যা কম হলে একজন পরীক্ষক খাতা দেখবেন। আগে প্রতিদিন ছয়টি করে খাতা দেখার বিধান রেখেছিলাম, এখন আটটি করে খাতা দেখার বিধান রাখতে যাচ্ছি। এই নিয়মগুলো হয়ে  গেছে। আগামী একাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠকে এগুলো অনুমোদিত হবে।’