১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের যে ঘটনা বাড়িয়েছে বিএনপি-ভারতের সম্পর্কের তিক্ততা

প্রকাশকালঃ ০৩ এপ্রিল ২০২৪ ১১:৪৮ পূর্বাহ্ণ ২৫৪ বার পঠিত
১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের যে ঘটনা বাড়িয়েছে বিএনপি-ভারতের সম্পর্কের তিক্ততা

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার ২০০১-২০০৬ সালে ক্ষমতায় থাকার সময় যেসব ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন এবং সরকারের মধ্যে প্রবল অস্বস্তি তৈরি করেছিল তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১০ ট্রাক সমপরিমাণ অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়টি। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান আটক করা হয় ২০০৪ সালের পহেলা এপ্রিল রাতে। দুটি বড় ট্রলারে করে এসব অস্ত্র সমুদ্রপথে আনা হয় চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার বা সিইউএফএল জেটিতে।

 

পর্যবেক্ষকদের অনেকই মনে করেন, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধারের সেই ঘটনা ভারতের সাথে তৎকালীন বিএনপি সরকারের মধ্যে শীতল সম্পর্কের সূচনা করেছিল। দেশটির তৎকালীন কর্মকর্তারা দাবি করেছিলেন যে ভারতের চাপে পড়েই বিএনপি সরকার সেসব অস্ত্র আটক করে। অন্যথায় সেসব অস্ত্র ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে যেত।

 

বিএনপি অবশ্য বরাবরই দাবি করে যে সরকার তখন ব্যবস্থা নিয়েছিল বলেই সেসব অস্ত্র আটক করা হয়েছে। সরকার যদি চাইতো তাহলে সেগুলো ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে যেত। কিন্তু বক্তব্য যাই হোক, অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনার পর থেকে বিএনপি সরকারের সাথে ভারতের সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছায়।

 

ভারতের কর্মকর্তারা মনে করেন, এতো বড় আকারে না হলেও বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অস্ত্র ঢুকেছে। দশ ট্রাক অস্ত্র আটকের বিষয়টি চোখে আঙুল দিয়ে সেটি দেখিয়ে দিয়েছে। সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় যে সিইউএফএল জেটিতে এসব অস্ত্র খালাস হবার সময় পুলিশ হেডকোয়ার্টারের সহায়তায় সেগুলো আটক করা হয়।

 

উদ্ধার করা আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে ছিল চীনের তৈরি একে-৪৭ রাইফেল, সেমি অটোমেটিক রাইফেল, রকেট লঞ্চার, রকেট শেল, পিস্তল, হ্যান্ড গ্রেনেড, বিপুল পরিমাণ গুলি ও বিস্ফোরক দ্রব্য। এই অস্ত্র যখন গণনা করা হয় তখন দেখা গেল ১ হাজার ৭৯০টি বিভিন্ন ধরণের অস্ত্র, সাড়ে ১১ লাখ গুলি, সাড়ে ৬ হাজার ম্যাগাজিন, ২৭ হাজার গ্রেনেড এবং ১৫০টি রকেট লঞ্চার।

 

সেদিন দিবাগত রাত দুইটা থেকে ভোর ছয়টা এ উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের তৎকালীন ডিসি (পোর্ট) আবদুল্লাহেল বাকি ও এসি (পোর্ট)। প্রায় ত্রিশজন পুলিশের সাথে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয় কোস্টগার্ডের সদস্যরা। অভিযোগ ওঠে কর্ণফুলী থানার তৎকালীন ওসির ভূমিকা নিয়ে। ইউরিয়া সার কারখানা লিমিটেডের জেটিতে চোরাচালানিদের অস্ত্র খালাসের সময় ওসি নিজে উপস্থিত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে বলে সংবাদমাধ্যমে বলা হয়।

 

ভারতের সাথে সম্পর্কের অবনতি

দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের আগে থেকেই বিএনপি সরকারের সাথে ভারতের সম্পর্ক খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না। এর মূলে ছিল নিরাপত্তা ইস্যু। ভারত তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের নিরাপত্তা নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিল। ভারতের অভিযোগ ছিল দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে মদদ দিচ্ছে বিএনপি সরকার। এমন অবস্থায় দশ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ে।

 

তখন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার ছিলেন বীনা সিক্রি। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, উত্তর-পূর্ব ভারতের তৎকালীন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশের ভেতরে বসে নানা কাজকর্ম করছিল। “চট্টগ্রামে যখন বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ধরা পড়লো তখন এসব ঘটনার সাথে তৎকালীন সরকারের সম্পৃক্ততার বিষয়টি একেবারে প্রকাশ্যে চলে আসলো,” বলেন বীনা সিক্রি।

 

তিনি বলেন এই ঘটনার সাথে সরকারের সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিয়ে যত খবর প্রকাশিত হতে থাকলো, ভারত সরকার ততই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। বীনা সিক্রি বলেন, এসব অস্ত্র এসেছিল চীন থেকে। চীনের কারখানায় এগুলো তৈরি হয়েছিল। “এসব বিষয় নিয়ে বিএনপি সরকারের কাছ থেকে কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। আমরা বিষয়টি বিভিন্ন ফোরামে তুলেছি, আলোচনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোন উত্তর কখনোই পাওয়া যায়নি,” বলেন বীনা সিক্রি।

 

 

অস্ত্র আটকের ঘটনাটি যখন ঘটেছিল তখন কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন তৌহিদ হোসেন। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ভারত সবসময় চেয়েছে যে আওয়ামী লীগ যাতে ক্ষমতায় ফিরে আসে। তিনি মনে করেন, অস্ত্রের চালানটি যেভাবে ধরা পড়েছিল, ভারত সেভাবেই চেয়েছিল। তিনি উল্লেখ করেন, এই চালানটি বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকার জন্য অপেক্ষা করছিল ভারত।

 

“আমরা অনেকটা জানি বা শুনেছি যে ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্সের তথ্যের ভিত্তিতে এবং অনেকটাই সময়মতো ও সরেজমিনে ইন্টাফিয়ারেন্সের কারণেই আটক করা গেছে। কিন্তু এটা তো অফিসিয়ালি বিষয়টা কোন পক্ষই বলেনি,” বলেন তৌহিদ হোসেন। তবে দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা বিএনপি ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক চূড়ান্ত অবনতির দিকে নিয়েছিল কী না সেটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন মি. হোসেন।

 

“আমি মনে করিনা যে ঐ ঘটনাটাই চূড়ান্ত ছিল। এসব ঘটনা সম্পর্ককে এফেক্ট করেছে। কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে তারা চায়নি যে বিএনপি ক্ষমতায় থাকুক।” “এটা যদি একেবারেই এমন হতো যে সরকারি মদদে পুরোপুরি হচ্ছে তাহলে এরকম ঘটনায় দুজন লোয়ার র‍্যাংকিং পুলিশ অফিসার গিয়ে সেটা আটকে দিল। এটা কি হয়? এটা হয়না। কিন্তু সরকারের ভেতর কেউ কেউ হয়তো জড়িত ছিল। সেটা না হলে ঘটনা এতদূর এগুতে পারতো না,” বলেন মি. হোসেন।

 

তৌহিদ হোসেনের ভাষ্য হচ্ছে, “যারা অকুস্থলে গিয়ে অস্ত্র ধরেছে, সম্ভবত ভারতীয় ইন্টেলিজেন্স তাদের আলাদাভাবে ফিট করেছে” সেই ঘটনার ২০ বছর পরে এসে বিএনপি নেতারা নতুন করে বিষয়টি নিয়ে আর কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। ২০১৪ সালে নিম্ন আদালতে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ের পর বিএনপির তরফ থেকে বিষয়টিকে ‘প্রহসন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল।

 

বিএনপিকে ‘ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে’ এই রায় দেওয়া হয়েছে বলে ২০১৪ সালে মন্তব্য করেছিলেন বিএনপি নেতা রিজভী আহমেদ। দশ ট্রাক অস্ত্রের চালানটি আটক করার ঘটনা ঘটে বিএনপি সরকারের আমলে এবং তা আটকের পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলোও শুরু হয় বিএনপি সরকারের সময় থেকেই। রিজভী আহমেদ দাবি করেন এই অস্ত্র মামলার বিচার শুরু করতে গেলে তার আগে যেসব বিচারিক প্রক্রিয়াগুলোর প্রয়োজন তা তাদের শাসনামলেই শুরু হয়েছিল। ২০০৪ সালে কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন তৌহিদ হোসেন।

 

রাজনীতিতে বাদানুবাদ

এই ঘটনার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফু্জ্জমান বাবর বলেছিলেন, চট্টগ্রামে আটককৃত ১০ ট্রাক অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহার এবং নাশকতার জন্য আনা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কথা সরাসরি উল্লেখ না করে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, “ ৩০শে এপ্রিলের মধ্যে তারা যেহেতু এ সরকারের পতন ঘটাবে বলেছে তাতে এ বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না।”

 

অন্যদিকে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা অস্ত্র আটকের ঘটনায় আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেন। শেখ হাসিনা বলেন, সরকার যদি আন্তর্জাতিক তদন্তের মাধ্যমে অবৈধ অস্ত্রের রহস্য উদঘাটন না করে তাহলে প্রমাণিত হবে এর সঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা জড়িত। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ ঘটনাটিকে রহস্যপূর্ণ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, সরকারের কোন অথরিটির যোগসাজশ ছাড়া এত বড় চালান দেশে আনা সম্ভব নয়।

 

 

অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে নানা খবরা-খবর প্রকাশিত হতে থাকে। ঘটনার একদিন পরে দৈনিক যুগান্তর শিরোনাম করে – হাজার কোটি টাকার অস্ত্র: গন্তব্য কোথায়? “চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র ও গোলাবারুদ আটকের ঘটনায় সমগ্র জাতি স্তব্ধ। কারা এনেছে এত অস্ত্র? অস্ত্র চালানের গন্তব্য কোথায়? সারাদেশে মুখে মুখে অস্ত্র আটকের খবর। দেশের অভ্যন্তরে নাশকতার জন্য নাকি এ অস্ত্র উলফারে কাছে পাঠানোর জন্য আনা হয়েছিল?” এসব নানা প্রশ্ন তোলা হয় দৈনিক যুগান্তরের একটি প্রতিবেদনে।

 

ঘটনার দুদিন পরে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অস্ত্র নামছিল পুলিশ পাহারায়। সে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সিইউএফএল জেটিতে স্থানীয় থানা পুলিশের উপস্থিতিতেই চোরাচালানিরা মাছ ধরার ট্রলার থেকে অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ খালাস করছিল। জেটিতে কর্তব্যরত আনসার সদস্য ও সিইউএফএল ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে খবর পেয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তৎপরতায় দেশের ইতিহাসে বৃহত্তম অস্ত্র ও গোলাবারুদের অবৈধ চালানটি ধরা পড়ে।

 

এমন অবস্থায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রেসনোট জারি করা হয়। সেখানে বলা হয়েছিল, 'অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের ব্যাপারে বাংলাদেশি সংবাদপত্রে প্রকাশিত কিছু অনুমান-নির্ভর প্রতিবেদনের প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। সরকার মনে করে, তদন্ত চলার সময় বিষয়টির ব্যাপারে গণমাধ্যমে অনুমান-নির্ভর প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তা জনমনে বিভ্রান্তি ও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করবে। বিষয়টি তদন্তের জন্য সরকার ইতোমধ্যেই স্বরাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে এবং এ ব্যাপারে জোর অনুসন্ধান চলছে'। দশট্রাক অস্ত্র মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত লুৎফুজ্জামান বাবর।

 

বিরোধী দলের পক্ষ থেকে যখন আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি তোলা হয় তখন বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক তদন্ত করা হবে। প্রকৃতপক্ষে, মান্নান ভুঁইয়ার সে বক্তব্য ছিল অনেকটা কথার কথা। সরকার কখনোই আন্তর্জাতিক তদন্তের বিষয়টি চিন্তা করেনি এবং সেটি হয়নি।

 

স্বরাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে সরকার যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল সেখানে আরো ছিলেন ডিজিএফআই’র তৎকালীন প্রধান ব্রিগেডিয়ার রেজ্জাকুল হায়দার, এনএসআই প্রধান ব্রিগেডিয়ার এনামুর রহমান। অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় নানাদিক নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় হরেক রকমের প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকে। সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে সরকার স্পষ্টতই অস্বস্তিতে ছিল। সেটির প্রতিফলনও দেখা যায় পরবর্তীতে।

 

 

ঘটনার কয়েকদিন পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সাংবাদিকদের একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে বলেন, দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে এমন ছবি ও সংবাদ ছাপাবেন না। “নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ করলে দেশের ক্ষতি ছাড়াও সাংবাদিক মহলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়,” বলেন খালেদা জিয়া।

 

ভারতের চাপে অস্ত্র আটক?

অস্ত্র উদ্ধারের পরদিন ভারতের আসাম ট্রিবিউন পত্রিকায় বলা হয় – এই অস্ত্র উলফার। দিল্লি-ভিত্তিক সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি বলেছিল, কিছুদিন আগে ভুটানে পরিচালিত অপারেশন অল ক্লিয়ার উলফার অস্ত্রভাণ্ডারকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। সেই অভিযানের পর থেকেই উলফা অস্ত্র সংগ্রহের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে।

 

ভারতের আরেকটি ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে বিপুল অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় ভারত নড়েচড়ে বসে ভাবতে শুরু করেছে, এই মারণাস্ত্রের গন্তব্য সে নিজেই কিনা। “পশ্চিম ভুটানে উলফা গেরিলারা গত ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে যে ধাক্কা খেয়েছে এবং যে পরিমাণ অস্ত্র তাদের হারাতে হয়েছে তা পূরণের জন্যই সম্ভবত এ অস্ত্র আনা হচ্ছিল,” বলেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী।

 

 

বাংলাদেশের অস্ত্রের চালান ধরা পড়ায় তিনি বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ দেন। অস্ত্র উদ্ধারের পর টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ত্রিপুরা পুলিশের তৎকালীন মহাপরিচালক জিএন শ্রীবাস্তবকে উদ্ধৃত তরে একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘ভারতের প্রতি বন্ধু-ভাবাপন্ন’লোকদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ অস্ত্রের বৃহত্তম চালানটি আটকে সক্ষম হয়েছে। সে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে যে অস্ত্রের চালানটি উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলোর মধ্যে বিতরণের জন্য আসছিল।

 

ভারতের ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির সাবেক উপ-মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) গঞ্জিত সিং ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের ইন্ডিয়া টুডেকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেন, সেই ১০ ট্রাক অস্ত্র শুধু উলফার জন্য আনা হয়নি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে আরো যারা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ছিল তাদের জন্যও এটি আনা হয়েছিল।

 

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের ভাষ্য হচ্ছে – উলফার তৎকালীন কমান্ডার-ইন-চিফ পরেশ বড়ুয়া এসব অস্ত্র আনার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছেন। তার লক্ষ্য ছিল আসামে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন জোরদার করা। মেজর জেনারেল (অব.) গঞ্জিত সিং ইন্ডিয়া টুডেকে বলেছেন, বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা-ডিজিএফআই এবং জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা-এনএসআই’র সাথে সমন্বয়ের ভিত্তিতে কাজ করেছিল পরেশ বড়ুয়া।

 

ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৪ সালে গঞ্জিত সিং এসব অস্ত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। চীনের দক্ষিণাঞ্চলের বিহাইস বন্দরে থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে অস্ত্র-ভর্তি এই জাহাজটির কীভাবে এবং কোন পথে আসছিল সেটির ওপর গোয়েন্দা নজর রাখছিলেন মি. সিং। “চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ের একটি হোটেল থেকে কাজ করছিলেন পরেশ বড়ুয়া। তার কাছাকাছি ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তারাও ছিল। এসব অস্ত্র চট্টগ্রামের সিইউএফএল জেটিতে পৌঁছানোর সব খবর আমাদের কাছে ছিল।”

 

মি. সিং বলেন, জাহাজটি সিইউএফএল জেটিতে আসার পর তাদের ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করে। “চট্টগ্রামের পুলিশ ভেবেছিল এসব অস্ত্র আওয়ামী লীগকে সহায়তার জন্য ভারত থেকে এসেছে।

 

 

কারণ, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল তখন সরকার হঠানোর জন্য এপ্রিল মাসের ৩০ তারিখে একটি ডেডলাইন দিয়েছিলো। উলফার নেতা অরবিন্দ রাজখোয়া (ডানে) এবং ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিবের মধ্যে বৈঠক হয় ২০১১ সালে। উলফা তার আগে থেকে অস্ত্র ত্যাগ করেছিল।

 

মামলার নতুন মোড়

১০ ট্রাক অস্ত্র ও গোলাবারুদ আটক করার ওই ঘটনায় কর্ণফুলী থানা পুলিশ বাদী হয়ে অস্ত্র ও চোরাচালান আইনে দুটি মামলা করে। ঘটনা তদন্তের পর তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা দায়সারা গোছের একটি অভিযোগপত্র দাখিল করার পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই মামলার অধিকতর তদন্ত শুরু হয়।

 

অস্ত্রের বিশাল একটি চালান আটকের ঘটনায় সম্পৃক্ততার দায়ে চট্টগ্রামের একটি আদালত ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে বিএনপির নেতৃত্বে জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা লুৎফুজ্জামান বাবর এবং দুটি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১৪জনকে ফাঁসির আদেশ দেয়। চট্টগ্রামের বিশেষ আদালত ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়াকেও ওই মামলায় ফাঁসির আদেশ দিয়েছিল।